পাতা:প্রবাসী (অষ্টম ভাগ).pdf/৩১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আর কোনো বাধা থাকবে না । QS)や বরদাসুন্দর হারান বাবুকে ডাকিয় পাঠাইলেন। সেদিন কাগজে ব্রাহ্মসমাজের বর্তমান দুৰ্গতির আলোচনা ছিল। তাহার মধ্যে পরেশ বাবুর পরিবারের প্রতি এমন ভাবে লক্ষ্য করা ছিল যে, কোনো নাম না থাকা সত্বেও আক্রমণের বিষয় যে কে তাহা সকলের কাছেই বেশ স্পষ্ট হইয়াছিল ; এবং লেখক যে কে তাহাও লেখার ভঙ্গীতে অনুমান করা কঠিন হয় নাই। কাগজখানায় কোনোমতে চোখ বুলাইয়াই স্বচরিতা তাহা কুটি কুট করিয়া ছিড়িতেছিল। ছিড়িতে ছিড়িতে কাগজের অংশগুলিকে যেন পরমাণুতে পরিণত করিবার জন্য তাহার রোথ চড়িয়া যাইতেছিল। এমন সময় হারান বাবু ঘরে প্রবেশ করিয়া মুচরিতার পাশে একটা চৌকি টানিয়া বসিলেন। স্বচরিতা একবার মুখ তুলিয়াও চাহিল না, সে যেমন কাগজ ছিড়িতেছিল তেমনি ছিড়িতেই লাগিল। হারানবাবু কহিলেন, “স্বচরিতা, আজ একটা গুরুতর কথা আছে। আমার কথায় একটু মন দিতে হবে।” স্বচরিতা কাগজ ছিড়িতেই লাগিল। নথে ছেড়া যখন অসম্ভব হইল তখন থলে হইতে কঁচি বাহির করিয়া কাচিট দিয়া কাটিতে লাগিল। ঠিক এই মুহুর্তেই ললিতা ঘরে প্রবেশ করিল। হারান বাবু কছিলেন, “ললিতা, সুচরিতার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।” ললিতা ঘর হইতে চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেই স্বচরিত তাহার আঁচল চাপিয়া ধরিল। ললিত কহিল,"তোমার সঙ্গে পামু বাবুর যে কথা আছে!" সুচরিত। তাহার কোনো উত্তর না করিয়া ললিতার আঁচল চাপিয়াই রহিল—তখন ললিতা সুচরিতার আসনের এক পাশে বসিয়া পড়িল । হারান বাবু কোনো বাধাতেই দমিবার পাত্র নহেন। তিনি আর ভূমিকা মাত্র না করিয়া একেবারে কথাটা পাড়িয়া বসিলেন। কহিলেন, “আমাদের বিবাহে আর বিলম্ব হওয়া আমি উচিত মনে করিনে। পরেশ বাবুকে জানিয়েছিলাম ; তিনি বল্লেন, তোমার সন্মতি পেলেই আমি স্থির করেছি, আগামী রবিবারের পরের রবিবারেই—” প্রবাসী। [ ৮ম ভাগ। সুচরিত কথা শেষ করিতে না দিয়াই কহিল, “না।" সুচরিতার মুখে এই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, স্বপষ্ট এক্ট, উদ্ধত "না" শুনিয়া হারান বাবু থমকিয়া গেলেন। সুচরিতাকে তিনি অত্যন্ত বাধ্য বলিয়া জানিতেন। সে যে একমাত্র "না" বাণের দ্বারা তাহার প্রস্তাবটাকে এক মুহূর্বে অৰ্দ্ধপথে ছেদন করিয়া ফেলিবে ইহা তিনি মনেও করেন নাই। তিনি বিরক্ত হইয়া কহিলেন—“না! না মানে কি ? তুমি আরো দেরি করতে চাও?” সুচরিতা আবার কহিল, “না।” হারান বাবু বিস্থিত হইয়া কছিলেন, “তবে ?” স্বচরিতা মাথা নত করিয়া কহিল, “বিবাহে আমার মত নেই।” হারান বাবু হতবুদ্ধির ন্যায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “মন্ত নেই ? তার মানে ?” ললিতা ঠোকর দিয়া কহিল, “পায় বাবু, আপনি আৰু বাংলা ভাঁধা ভুলে গেলেন না কি ?” হারান বাবু কঠোর দৃষ্টি দ্বারা ললিতাকে আঘাত করিয়া কহিলেন, “বরঞ্চ মাতৃভাষা ভুলে গেছি একথা স্বীকার করা সহজ কিন্তু যে মানুষের কথায় বরাবর শ্রদ্ধা করে এসেছি তাকে ভুল বুঝেছি একথা স্বীকার করা সহজ নয়।" ললিত কহিল, “মানুষকে বুঝতে সময় লাগে, আপনার সম্বন্ধেও হয় ত সেকথা খাটে !” হারান বাবু কহিলেন, “প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত আমার কথার বা মতের বা ব্যবহারের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি-আমি আমাকে ভুল বোঝবার কোনো উপলক্ষ্য কাউকে দিইনি একপ আমি জোরের সঙ্গে বলতে পারিসুচরিতাই বলুন আমি ঠিক বলচি কি না!" ললিতা আবার একটা কি উত্তর দিতে যাইতেছিল— · স্বচরিতা তাহাকে থামাইয়া দিয়া কহিল—“আপনি ঠিক ৰলচেন! আপনাকে আমি কোনো দোষ দিতে চাইনে!” হারান বাবু কহিলেন, “দোষ যদি না দেবে তবে আমার প্রতি অন্যায়ই বা করবে কেন ?” স্বচরিতা দৃঢ়স্বরে কহিল, “যদি একে অন্যায় বলেন তবে আমি অন্যায়ই করব—কিন্তু"— বাহির হইতে ডাক আসিল, “দিদি, ঘরে আছেন ?” | ১০ম সংখ্যা । ] স্বচরিতা উৎফুল্প इहेश ੇ उड़ाखाड़ि কলি "আমুন, বিনয় বাৰু, আমুন!” “ভুল করচেন দিদি, বিনয় বাবু আসেননি, আমি বিনয় মাত্র, আমাকে সমাদর করে লজ্জা দেবেন না”—বলিয়া বিনয় ঘরে প্রবেশ করিয়াই হারান বাবুকে দেখিতে পাইল । হারান বাবুর মুখের অপ্রসন্নতা লক্ষ্য করিয়া কহিল— "অনেক দিন আসিনি বলে রাগ করেচেন বুঝি !” হারান বাবু পরিহাসে যোগ দিবার চেষ্টা করিয়া কছিলেন, “রাগ করবারই কথা বটে। কিন্তু আজ আপনি একটু অসময়ে এসেচেন—স্বচরিতার সঙ্গে আমার একটা বিশেষ কথা হচ্ছিল |” বিনয় শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিল—“ঐ দেখুন, আমি কখন এলে যে অসময়ে আসা হয় না তা আমি আজ পর্যন্ত বুঝতেই পারলুম না! এই জন্যই আসতে সাহসই হয় না!” বলিয়া বিনয় বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। স্বচরিতা কহিল “বিনয় বাবু, যাবেন না। আমাদের কথা ছিল শেষ হয়ে গেছে। আপনি বসুন।” বিনয় বুঝিতে পারিল সে আসাতে মুচরিতা একটা বিশেষ সঙ্কট হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছে। খুসি হইয়া একটা টেকিতে বসিয়া পড়িল এবং কহিল “আমাকে প্রশ্রয় দিলে আমি কিছুতেই সাম্লাতে পারিনে। আমাকে বসতে বললে আমি বসবই এই রকম আমার স্বভাব। অতএব, দিদির প্রতি নিবেদন এই যে, এসব কথা যেন বুঝে সুঝে বলেন, নইলে বিপদে পড়বেন।” হারান বাবু কোনো কথা না বলিয়া আসন্ন ঝড়ের মত স্তন্ধ হইয়া রছিলেন। তিনি নীরবে প্রকাশ করিলেন, আচ্ছা বেশ, আমি অপেক্ষা করিয়া বসিয়া রহিলাম-আমার যা কথা আছে তাহ শেষ পর্য্যন্ত বলিয়। তবে আমি উঠিব। দ্বারের বাহির হইতে বিনয়ের কণ্ঠস্বর শুনিয়াই ললিতার বুকের ভিতরকার সমস্ত রক্ত যেন চমক খাইয়া উঠিয়াছিল। সে বহুকষ্টে আপনার স্বাভাবিক ভাব রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিল কিন্তু কিছুতেই পারিল না। বিনয় যখন ঘরে প্রবেশ করিল ললিতা বেশ সহজে তাহাদের পরিচিত বন্ধুর মত তাহাকে কোনো কথা বলিতে পারিল না। কোন দিকে চাহিৰে, নিজের হাতখান লইয়া কি করিবে সে যেন গোরা । ۹ بt) একটা ভাবনার বিষয় হইয়া পড়িল। একবার উঠিয়া যাইবার চেষ্টা করিয়াছিল কিন্তু সুচরিতা কোনমতেই তাহার কাপড় ছাড়িল না। বিনয়ও যাহা কিছু কথাবার্তা সমস্ত স্বচরিতার সঙ্গেই চালাইল-ললিতার নিকট কোনো কথা ফাদা তাহার মত বাকৃপটু লোকের কাছেও আজ শক্ত হইয়া উঠিল। এই জন্যই সে যেন ডবল জোরে স্বচরিতার সঙ্গে আলাপ করিতে লাগিল—কোথাও কোনো ফাক পড়িতে দিল না। কিন্তু হারান বাবুর কাছে ললিতা ও বিনয়ের এই নূতন সঙ্কোচ অগোচর রহিল না। যে ললিতা তাহার সম্বন্ধে আজকাল এমন প্রখর ভাবে প্ৰগলভ হইয়া উঠিয়াছে সে আজ বিনয়ের কাছে এমন সঙ্কুচিত ইহা দেখিয়া তিনি মনে মনে জলিতে লাগিলেন এবং ব্রাহ্মসমাজের বাহিরের লোকের সহিত কন্যাদের অবাধ পরিচয়ের অবকাশ দিয়া পরেশ বাবু যে নিজের পরিবারকে কিরূপ কদাচারের মধ্যে লইয়া যাইতেছেন তাহা মনে করিয়া পরেশ বাবুর প্রতি তাহার ঘৃণা আরো বাড়িয়া উঠিল এবং পরেশ বাবুকে যেন একদিন এজন্য বিশেষ অনুতাপ করিতে হয় এই কামনা র্তাহার মনের মধ্যে অভিশাপের মত জাগিতে লাগিল । অনেক ক্ষণ এই ভাবে চলিলে পর স্পষ্টই বুঝা গেল হারান বাবু উঠিবেন না। তখন স্বচরিতা বিনয়কে কহিল, “মাসীর সঙ্গে অনেক দিন আপনার দেখা হয়নি। তিনি আপনার কথা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করেন। একবার তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন না ?” বিনয় চৌকি হইতে উঠিয়া দাড়াইয়া কহিল—“মাসির কথা আমার মনে ছিল না এমন অপবাদ আমাকে দেবেন না।” ” স্বচরিতা যখন বিনয়কে তাছার মাসির কাছে লইয়া গেল তখন ললিত উঠিয়া কহিল, “পায় বাবু, আমার সঙ্গে আপনার বোধ হয় বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই।” হারানবাবু কহিলেন “না। তোমার বোধ হয় অন্যত্র বিশেষ প্রয়োজন আছে। তুমি যেতে পার!” ললিত কথাটার ইঙ্গিত বুঝিতে পারিণ। সে তৎক্ষণাৎ - উদ্ধত ভাবে মাথা তুলিয়া ইঙ্গিতকে স্পষ্ট করিয়া দিয়া কহিল—“বিনয় বাৰু আজ অনেক দিন পরে এসেচেন, তার