কবি মনোহর দাস গ্রীরামপদ মুখোপাধ্যায় সম্মুখে নদী, উপরে আকাশ, পিছনে বনচ্ছায়া—এমন পরিবেশ থাকিলেই যে মানুষ কবি হইয়া উঠিবে তাহার কোন নিশ্চয়ত নাই । অথচ বিখ্যাত কবি মনোহর দাসের স্মৃতি বর্ণন করিতে আসিয়া শহরের সাহিত্যিকমণ্ডলী প্রতি বৎসরই ঐগুলিকে কবি-জীবনের অপরিহার্য্য অঙ্গ বলিয়া ঘোষণা করিয়া থাকেন । ঘোষণা যে র্তাহাদের অমূলক, এমন কথা বলিবার সাহস অবশ্ব কাহারও নাই । কারণ, কবির কাব্য হইতে এমন অনেক অংশ উদ্ধত করা যাইতে পারে—যাহাতে মাঠ, বন, নদী, আকাশ ইত্যাদির অপরূপত্ব মনকে স্পর্শ করিবারই কথা। কিন্তু কেন স্পষ্ট-প্রত্যক্ষ জিমিষের মধ্য দিয়া অপ্রত্যক্ষীভূত দ্রব্যসমূহে কবি আত্মসমর্পণ করেন—যে-তথ্য পরিস্ফুট করিবার চেষ্টা অল্পজনেই করিয়া থাকেন। অধিকাংশ মানুষই বাহিরটাকে দেখিয়া ভুল যুক্তির পথে বিভ্রান্ত শকটখনিকে চালাইয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়া থাকেন। স্মৃতি-পূজা তাই স্তুতি-পূজার নামাস্তর হইয়া দাড়ায় ! কবি যখন একাগ্র সাধনা বলে অপরিমিত fখ্যাতি লাভ করেন—তাহার পূৰ্ব্বেকার মাতুষ তখন নঃশেষিত। মাতুষের চিতার অঙ্গারে কবির নবজন্ম— একথা তোমরা জান কি ? না জান তো শোন। নদীর ধারেই ছিল গ্রাম—জনবহুল গ্রাম । গ্রামবাসীদের আন্তরিকতা-বিবাদে এবং মৈত্রীতে—যেমন প্রবল আবহমান কাল হইতে চলিতেছে—তেমনই হয়তো ছিল । অর্থহীন মনোহর দাসকে প্রতিবেশীদের সক্রিয় শক্তির আস্বাদ কিছু-না-কিছু লইতেই হইত। কিন্তু রমার প্রসাদ-পরিপুষ্ট নহেন বলিয়া সে অবজ্ঞা তাহার মৰ্ম্মভেদ করিতে পারে নাই । বাল্যকাল হইতে যে পারিপাশ্বিক তাহার কোমলতম বৃত্তিগুলিকে সজাগ করিয়া রাখিয়াছিল— সে ঐ নদী, আকাশ, মাঠ বা লতাগুল্ম নহে—সে অভাবগ্রস্ত সংসারের নানান দিক হইতে নানা ভাবে আঘাত দিবার পটুতা । আঘাত পাইলেই মনোহরকে নদী ডাকিত হাতছানি দিয়া, মৌন আকাশে ফুটিয়া উঠিত অসীম রহস্য; তিনি মাঠের তৃণাঞ্ছরে অপরূপ শোভা দেখিতেন ও পার্থীর কাকলীতে সাস্তুনা লাভ করিতেন। গ্রাম্য পাঠশালার সঙ্গে মাত্র তার পরিচয় । পয়ার ছন্দে মনোহর দাস সেই বিদ্যার পরিচয় দিতে অধীর হইতেন । র্তাহার র্কাচ হাতের ভাঙা ছন্দের বিন্যাসে ধরা পড়িত—মাঠ, নদী, আকাশ । বসিয়া দুঃখজয়ী মন তাহা উপভোগ করিত। দারিদ্র্য জন্মসঙ্গী হইলেও মনোহর দাস বিবাহ করিয়াছিলেন। বিবাহ করিয়াছিলেন বলিলে ভুল বলা হইবে ; বারো বৎসরের ছেলের সঙ্গে আট বৎসরের বালিকার যে বিবাহ তাহাতে ইহলৌকিক মুখসাধ ও পারলৌকিক ধৰ্ম্মরক্ষার হেতুটিরই প্রাবল্য দেখা যায় । সে চিন্তা র্যাহারা করিবার তাহারাষ্ট করিয়াছিলেন । অবশ্য মনোহর দাসের তাহাতে আপত্তি করিবার এতটুকু কারণ ঘটে নাই । চিরস্থায়ী একটি খেলিবার সঙ্গিনী পাইলে, কোন কিশোর না কলহে ও সৌহার্দ্যে পুলকচঞ্চল হইয় উঠে । উমার কালো মুথখানিও মনোহর দাসের ভাল লাগিত । গৌরবর্ণ মনোহরের পাশে কৃষ্ণ উমাকে দেখিলেই অনেকে ষলাবলি করিত, ‘আহা, রাধাকৃষ্ণ যেন রূপ বদলে ধরায় এসেছে ! হোক কালো, তবু কি শ্ৰী! তার পর আসিল সংসারের পুরা দায়িত্ব। মনোহর দাস তখন কুড়ি বৎসরের যুবক, উমা ষোড়শী । স্ত্রীর সঙ্গে খুনমুটি করিবার বয়স এক মুহূৰ্ত্তে মনোহর পার হইয়া গেলেন, উমার মুখেও গৃহিণীর গাম্ভীৰ্য নামিল। জমি যা ছিল সামান্তই ; দোকানের খাতা লিখিয়া মনোহরের পিতা সংসার চালাইতেন । অনভিজ্ঞ মনোহর জানেন থাত দুই একটি ভাঙ্গা ছন্দের পয়ার লিখিবার জন্যই, অস্তরালে
পাতা:প্রবাসী (ঊনচত্বারিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।