পাতা:প্রবাসী (চতুর্বিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ꮌb~o জালের জন্য শণের স্থত কাটিতে বসিত আর রামসরণ তাহার কাছে বসিয়া তামাক টানিত এবং মধ্যে-মধ্যে এক-গাল ধোয় ফুউ-উ করিয়া ফুলির মুথের উপর ছাড়িয়া দিত। তামাকের গন্ধে এবং ধোয়ায় ফুলির দম্ আটকাইয়; আসিত । “আ: কর কি” বলিয়া হাসিয়া সে তাহার মুখখান ধোয়ার কুণ্ডলী হইতে সরাইয়। লইত । দেখিয়া ব্রামচরণ হাসিত । সুতরাং দিন বেশ মুখেই যাইভেছিল। এক বছর পরে ফুলির মা মারা গেল । আশ্বিন মাসে ভয়ানক ঝড় হইল। সেদিন বনমালী পদ্মানদীতে মাছ ধরিতে গিয়াছিল । রাত্রে ঝড় প্রলয়মুৰ্বি ধরিল ; ঝড়ে ডাঙার গাছ উপন্ড্রাইয়া জলে ফেলিতে লাগিল, নদীর জল ঠেলিয়া ডাঙায় তুলিতে লাগিল । মহাকালের ফুংকারে সে-অঞ্চলের ঘর-বাড়ী, গাছপালা কোথায় যে উঠিয়া গেল তাহার উদ্দেশ পাওয়া গেল না । ঝড়ে জেলেদের অনেক নৌকা ডুবিল—অনেক লোকও মারা গেল। বনমালী ও তাঁহার নৌকা দুখানিরও কোন খোজ পাওয়া গেল না । বনমালী হঠাৎ মরিয়া গেল, সুতরাং সে যে টাকা কোথায় রাখিয়া গেল রামচরণ ও ফুলি তাহার কোনই সন্ধান পাইল না। কিন্তু রামচরণের কাকা গদাই একথা একেবারেই বিশ্বাস করিল না। সঞ্চিত টাকা তাহদের দুই ভাইয়ের রোজগার, স্বতরাং তাহার অৰ্দ্ধেক গদাইএর প্রাপ্য। রামচরণ যে তাহাকে ফাকি দিল, তাহাতে তাহার কোন সন্দেহ থাকিল না। টাকা মূখন সে সত্যই পাইল না, তখন রাগ করিয়া তাহার বাড়ীর অংশ বেচিয়া দিয়া স্ত্রীপুত্র লইয়া শ্বশুর-বাড়ী চলিয়া গেল । রামচরণ ও ফুলি প্রথমে মনে করিল বেশ হইল । কিন্তু অভাব যখন ক্রুর মুষ্টিতে দেখা দিল, তখন দু’জনেই ভয় পাইল । রামচরণ কি করিবে ভাবিয়া পাইতেছিল না । সে জেলে, মাছ-ধরা, মাছ-বেচা তাহার কাজ । তাহা ছাড়া আর যে কিছু করা যায়, তাহা তাহার মনেও আসিত না। অথচ মাছ ধরিবার মত শক্তিও তাহার নাই। রামচরণের হাসিতে-ভরা মুখ স্নান হইয়া পড়িল । স্বামীর মান মুখ ফুলির মনে মৰ্ম্মান্তিক ব্যথা পরের বছর প্রবাসী—অগ্রহায়ণ, ১৩৩১ [ ২৪শ ভাগ, ২য় খণ্ড জাগাইয়া তুলিল। সকল অনিষ্টের মূল ধে সেই-ই, একথা সে যতই ভাবিত ততই তাহার মন গ্লানিতে ভরিয়া যাইভ । সংসার যখন সভ্যই অচল হইল, তখন রামচরণ ফুলিকে বলিল, “আয়ু ফুলি, আমরা ভেক নিয়ে বোষ্টম হই, তবু দু-মুঠে। ভিক্ষে মিলবে।” কথাটা বলিতে-বলিতে রামচরণের চোখ জলে ভরিয়া আসিল । ফুলি তাহ দেখিল এবং সেই মুহূর্ভে সংসারের সকল ভার নিজের মাথায় তুলিয়া লইল । ফুলি বলিল, “ছি, ভিক্ষে করব কেন ? খাধি মাছ বেচব ।” রামচরণ ক্ষুঃস্বরে বলিল, “তোর বয়সে কে মাছ বেচ তে যায় রে ফুলি ? ফুলি বলিল, “হাট-বাজারে ত আর বাবে না। আমি গায়ের মেয়ে, কোন বাড়ীতে না গিয়েছি ? ভিন্‌ জাত হ’লেও সকলের সাথেই একট-না-একটা সম্পর্ক আছে, তাতে গায়ে মাছ বেচ তে আমার লজ্জা করবে না ” অবশেষে তাহার অক্ষমতার জন্য ফুলিকে ধে পথেপথে ঘুরিতে হইবে, ইহা রামচরণকে ব্যথিত করিতে লাগিল। কিন্তু ইহা ছাড়া আর উপায় নাই, কাজেই সে চুপ করিয়া রহিল । এক বুড়ী জেলেনী দয়া করিয়া নদী হইতে ফুলির জন্য মাছ কিনিয়া আনিয়া দিত, ফুলি গায়ে ফেরি করিত। কিছু উপার্জন হইতে লাগিল, স্বামী-স্ত্রীর মুখে আবার হাসি ফুটিল । কিন্তু দু’চার দিন পরেই ফুলি দেখিল ডাকের সম্পর্কের কোন মূল্য ত নাই-ই বরং সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার অজুহাতে গায়ের কতগুলি লোক তাহাকে উত্যক্ত করিয়া তুলিল । হঠাৎ ফুলির জন্য তাহদের মনে বিষম সহানুভূতি জাগিয়া উঠিল। পথে-ঘাটে ফুলিকে একা পাইলেই তাহারা তাহার জন্য এমন দুঃখ ও দরদ দেখাইত যেন হাত-পা-ভাঙা স্বামীর হাতে পড়িয়া, ফুলির অপেক্ষ তাহাদের ক্ষতিটা বেশী হইয়া গিয়াছে। লজ্জায়, অপমানে ফুলি কাদিয়া ফেলিত। কিন্তু রামচরণের নিকটে এসকল কথা কিছুই বলিত না, বলিলে প্রতিকার যে কিছু হইবে না তাহ সে জানিত, লাভের মধ্যে স্বামীর দুঃখ কেবল বাড়ানো হইবে । সমস্ত অপমান মাথায় বহিয়৷