পাতা:প্রবাসী (চতুর্বিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ఇవbళ প্রবাসী—পৌষ, ১৩৩১ [ ২৪শ ভাগ, ২য় খণ্ড আবরণটা ছাড়িয়ে নিয়ে দেখাই তা’কে সত্য দেখা এ কথা মানিনে। গোলাপ ফুলের মায়ার পর্দাট তুলে ফেলে তা’কে কাৰ্ব্বন নাইট্রোজেন বলে’ দেখা যেমন সত্য দেখা নয় এs তেমনি । তুমি বাস্তববাদী বলবে, গোলাপ ফুলের মায় অকৃত্রিম, মেয়ের মায়া কৃত্রিম। একেবারেই বাজে কথা। মেয়ে নিজের হাতে রঙ বেঁটে যখন তার কাপড় রাঙায় তখন তার হাতের গোপনে সেই প্রকৃতিই থাকে যে প্রকৃতি সকলের অগোচরে প্রজাপতির পাখায় নিজের অদৃপ্ত তুলি বুলিয়ে দেয়। প্রাণের রাজ্যে মায়ার খেলা কত বর্ণে গন্ধে রসে কত লুকোচুরিতে আভাসে ইসারায় দিনরাত প্রকাশ পাচ্চে । প্রকৃতির সেই সকল নিত্য অথচ অনিত্য চঞ্চলতায়, সেই সব নিরর্থক হাবভাবেই ত বিশ্বের সৌন্দৰ্য্য। চিরপলাতকের এই চিরপরিবর্তনশীল লীগ থেকে বাদ দিয়ে যে অতি সারবান ভারবান নিশ্চল ধূলোমাটি লোহাপাথরের পিওটা বাকি থাকে তা’ক্ষেই তুমি বাস্তবসত্য বল না কি ? বসনে ভূষণে, আড়ালে আবডালে, দ্বিধায় দ্বন্দ্বে, ভাবে ভঙ্গীতে মেয়ে ত মায়াবিনীই বটে। তার মায়ার জগতে সে ইন্দ্ৰজাল বিস্তার করেচে, যেমন মায়া, যেমন ইন্দ্রজাল জলে স্থলে, ফুলে ফলে, সমুদ্ৰ পৰ্ব্বতে, ঝড়ে বন্যায । যাই হোক এই মায়াবিনীই চাদের সঙ্গে, ফুলের সঙ্গে, নববর্ষার মেঘের সঙ্গে, কলমৃত্যভঙ্গিনী নদীর সঙ্গে মিলে’ পুরুষের সামনে এসে দাড়াল। এই নারী একটা বাস্তবের পিও মাত্র নয়, এর মধ্যে কলাস্যষ্টির একটা তত্ত্ব আছে, অগোচর একটি নিয়মের বাধনে, ছন্দের ভঙ্গীতে সে রচিত, সে একটি অনিৰ্ব্বচনীয় স্বসমাপ্তির মূৰ্ত্তি । নানা বাজে খুঁটিনাটিকে সে মধুর নৈপুণ্যে সরিয়ে দিয়েচে, সাজে সজ্জায় চালে চলনে নানা ব্যঞ্জনা দিয়ে নিজেকে সে বস্তলোকের প্রত্যন্তদেশে রসলোকের অধিবাসিনী করে দাড় করিয়েচে । “কাজ করে’ থাকি”—এই কথাটা জানিয়ে পুরুষ হাত খালি রেখেচে ; মেয়ে সেই হাতে কাকন পরে’ জানিয়েচে, “আমি ত কাজ করিনে, আমি সেবা করি।” সেবা হ’ল হৃদয়ের সৃষ্টি, শক্তির চালনা নয়। যে-রাস্তায় চলবে সেই রাকাটাকে খুব স্পষ্ট করে নিরীক্ষণ করবার জন্তে পুরুষ তার চোখ দুটো খুলে রেখেছে, ওটাকে সে গভীর ভাষায় “বলে দর্শনেন্দ্রিয়। মেয়ে সেই চোখে একটু কাজলের রেখা টেনে দিয়ে বলেচে, চোখ দিয়ে বাইরের জিনিষ দেখা যায় এইটেই চরম কথা নয়, চোখের ভিতরেও দেখবার জিনিষ আছে, হৃদয়ের বিচিত্র মায়া। অস্তরে বাহিরে হৃদয়ের রাগরঞ্জিত লীলা নিয়ে পুরুষের জগতে নারী মূৰ্ত্তিমতী কলালক্ষ্মী হয়ে এল। রস যেখানে রূপ গ্রহণ করে সেই কলামূৰ্ত্তির গুণ গুচ্চে এই যে, তার রূপ তা’কে অচল বাধনে বাধে না । খবরের কাগজের ংবাদ-লেখা প্যারাগ্রাফে ছন্দ নেই, রস নেই, সেই জন্তে সে একেবারে নিরেট, সে যা সে তা’ই মাত্র । মন তার মধ্যে ছুটি পায় না। ভালো কবিতা যে-রূপ গ্রহণ করে সে-রূপ নির্দিষ্ট হ’য়েও অনির্দিষ্ট, পাঠকের স্বাতন্ত্রাকে সে হাকিয়ে দেয় না । মনে আছে, বহুকাল হ’ল, রোগশয্যায় কালিদাসের কাব্য আগাগোড়া সমস্ত পড়েছিলুম। যে আনন্দ পেলুম সে ত আবৃত্তির আনন্দ নয়, স্বষ্টির আনন্দ । সেই কাব্যে আমার মন আপন বিশেষ স্বত্ব উপলব্ধি করবার বাধা পেল না। বেশ বুঝলুম, এ সব কাব্য আমি যেরকম করে পড়লুম দ্বিতীয় আর কেউ তেমন করে’ পড়েনি । মেয়ের মধ্যেও পুরুষের কল্পনা তেমনি করে’ই আপন মুক্তি পায়। নারীর চারিদিকে যে পরিমণ্ডল আছে তা অনিৰ্ব্বচনীয়তার ব্যঞ্জনা দিয়ে তৈরি ; পুরুষের কল্পনা সেখানে আপনার রসের রঙ, আপনার ভাবের রূপ মিলিয়ে দিতে কঠিন বাধা পায় না। অর্থাৎ সেখানে তার নিজের স্বষ্টি চলে এই জন্যে তার বিশেষ আনন্দ । মোহমুক্ত মানুষ তাই দেখে হাসে ; কিন্তু মোহমুক্ত মানুষের কাছে স্বষ্টি বলে’ কোনো বালাই নেই, সে প্রলয়ের মধ্যে বাস করে। পূৰ্ব্বেই বলেচি মেয়ের প্রেম পুরুষের সমস্ত খুঁটিনাটি দোষক্ৰটি সমেত বিশেষত্বকে প্রত্যক্ষ করে” পেতে চায়। সঙ্গ তার নিতান্তই চাই। পুরুষও আপনাকে লুকিয়ে রাখেনি, ঢেকে রাখেনি ; সে অত্যন্ত অসজ্জিত এলোমেলো আটপৌরে ভাবেই মেয়ের ভালোবাসার কাছে আগাগোড়া নিজেকে ফেলে’ রেখে দিয়েচে ; এতেই মেয়ে যথার্থ সঙ্গ পায়, আনন্দ পায়।