পাতা:প্রবাসী (চতুর্বিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৬১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫ম সংখ্যা ] বামুন-বাগদী 6tS) কানাই তাড়াতাড়ি করিয়া বলিল, “দীত ত একটাও পড়েনি। আর চুল পেকেছে না হাতী হয়েছে। এই ত কত চুল এখনও কালো কুচকুচে রয়েছে। এই দাখন বল—চেয়ে দ্যাখ।” এই বলিয়া সে মহেশ্বরীর চুলগুলি ওলটপালট করিয়া, কখন বা চিরিয়া-চিরিয়া, কখনও বা গোছা ধরিয়া বলাইকে দেখাইতে লাগিল। বলাই কহিল, গুহা বড়-মা, অনেক চুলই ষে কাচ রয়েছে।” মহেশ্বরী বলিলেন, “পাকা ধরলে কি আর বেশীদিন কাচ থাকে ? ও ত পেকে গেল !” বস্তুতঃ মহেশ্বরী যেরূপ বলিতেছিলেন, তাহার বয়স তেমন বেশী হয় নাই। যাহা হউক তাহার বাক্যে কানাইলাল অত্যন্ত বিমর্ষ হইয়া পড়িল । সমস্ত দিনটা সে অস্বস্তিতে কাটাইল। পড়াশুনায়ও তেমন মন দিতে পারিল না। রাত্রিকালে মহেশ্বরী বই লইয়া তাহাকে যতগুলি প্রশ্ন করিলেন অধিকাংশেরই সে ভূল উত্তর করিল। মহেশ্বরী সে-সকল বুঝাইয়া দিয়া তাহাকে যাইয়া শয়ন করিতে বলিলেন। সে শুইলে কিছুক্ষণ পরে আলো নিবাইয়া তিনিও আসিয়া শয়ন করিলেন। কতকক্ষণ গেল—কানাইলাল ঘুমাইল না। মনের ছশ্চিন্ত৷ কিছুতেই সে দূর করিতে পারিতেছিল না। কেবলই এ-পাশ-ও-পাশ উস্থুস করিতে লাগিল। মহেশ্বরী কহিলেন, “হয়েছে কি আজ ? ঘুমোবি নে ?” সে চুপ করিয়া শুইল । কিছুক্ষণ বাদে সে মহেশ্বরীর বুকের উপর হাত রাখিয়া মৃদুস্বরে ডাকিল, “বড়-মা !” , - "কেন ?” “চুল পকূলে সত্যিই কি মানুষ মরে ?” “মরে বৈকি!” - “ও-বাড়ীর ভোলা ত কত ছোট, সে মরে গেল কেন ?” মহেশ্বরী কহিলেন, “সে অল্প-স্বল্প হঠাৎ যায়। চুল পাকৃলে—দাত পড়লে—যাবার সময় হয়, তখন আর কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না।” কম্পিত-কণ্ঠে কানাই জিজ্ঞাসা করিল, “একজন মন্থে আর একজন যদি না থাকৃতে পারে ?” *...* কানাইকে কোলের ভিতর টানিয়া লইয়া অাদরে ভরাইয়া দিয়া মহেশ্বরী বলিলেন, “না থাকৃতে পারলে চলবে কেন ? যাওয়া আর থাকা নিয়েই ত সংসার চলছে। কাকেও আসতে হবে—থাকৃতে হবে, কাকেও যেতে হবে।” মিষ্টস্বরে কানাই বলিল, “আচ্ছা, দু’জন একসঙ্গে গেলে হয় না ?” মহেশ্বরী তাহাকে চুম্বনে ছাইয়া দিলেন। বলিলোঁ, “ছিঃ ! অমন মনে করতে নেই। আমি আজই কি চলে যাচ্ছি ? তোমরা বড়-সড় হবে—ঘর-সংসার করবে— তবে না যাবো।” ág তার পর কানাইলাল নিশ্চিন্তু হইয়া ঘুমাইয়া পড়িল । কিন্তু সে-রাত্রে সে দুইতিন বার দুঃস্বপ্ন দেখিয়া ঘুমের ঘোরে মহেশ্বরীকে জড়াইয়া-জড়াইয়া ধরিল। কানাইলালের পুঞ্জীভূত বেদনার মাঝখানে যেন অমৃতের সন্ধান দিতে অকলঙ্ক মাতৃস্নেহ লইয়া একমাত্র মহেশ্বরীই তাহার সম্মুখে আসিয়া দাড়াইয়াছিলেন। মহেশ্বরী যে বেষ্টনে নিরাশ্রয় বালককে বক্ষোলগ্ন করিতে চাহিতেছিলেন, সংসারের পারিপাশ্বিক ঘটনার মধ্য দিয়া সে-গওঁী গড়িয়া তোলা মন্থরগতিতে হইলেও নিশ্চিত ছিল। কানাইলালের দুর্ব্যবহারের বেলা মহেশ্বরীর শাসননীতির মধ্যেও নুপুরধ্বনির মিষ্টতার মত এমন একটি সূক্ষ্ম আকর্ষণের ছন্দ বাজিয়া উঠিত যাহা বালক হইলেও বাছিয়া লইতে এবং উপলব্ধি করিতে কানাইলালের পক্ষে অসাধ্য হইত না । তাহার বিপ্লবময় শিশুজীবনে যখন এক-একটা দুর্ঘটনা জোকের মতন তাহাকে জড়াইয়া ধরিত তখন সে বুঝিত যে, তাহার মহেশ্বরী-মা ভিন্ন আর কেহ তাহাকে ছাড়াইয়া দিতে পারিবেন না । মহেশ্বরীর কাছছাড়া হইয়া খেলাধূলা করিবার সময়ও সে যেন সেই বিচিত্র মায়ার রাজ্যেই ঘুরিয়া-ফিরিয়া বেড়াইত। তাহার সেই মহেশ্বরী-মা সত্যসত্যই যখন এক-একদিন পীড়িত হইয়া শয্যাশায়ী হইতেন তখন তাহার আহার-নিদ্রা, পড়াশুনা, খেলা-ধূলা সকলই বন্ধ হইয়া যাইত। মহেশ্বরী তাহার