৫ম সংখ্যা] যে, মামুষের অস্তর-জগতে যতক্ষণ তৃপ্তি থাকে, তার কল্পলোকের স্বরের জালে যতক্ষণ বিষয়াতিরিক্ত সত্তার একটা স্পর্শ থাকে, ততক্ষণ বাইরের দিকের কোন দাবীরই সত্য হ’য়ে উঠবার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যখন এই স্ববের জাল কোনক্রমে গুলিয়ে যায়, কল্পলোকের আর কোন আনন্দের স্পর্শ পাওয়া যায় না, তখন বাইরের দিক থেকে এই আনন্দের তল্লাস পড়ে যায়। কল্পলোকের দারিদ্র্য আমরা বাস্তব-জগতের সম্পদ দিয়ে ভরে রাখতে চাই । সে যা হোক মুকুলিকা দেবীকে যখন আমার কল্পলোকের সুর দিয়ে ছোয়া গেল না, তখন তার চাক্ষুষ পরিচয়ের একটা আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে আমার অন্তরে মাথা তুলতে লাগল। মুকুলিকা দেবীর পরিচয় স্পষ্ট হ’য়ে মনের কাছে তা এমনি আবছা হয়ে উঠল, নিকটে এসে তা এমনি একটা দূরত্ব রচনা করলে যে আমার অন্তর-লোকের একটা পরিপূর্ণ সন্তোষের কোঠা একেবারে শন্য হ’য়ে গেল। এথন এই শূন্যতা পূর্ণ করা যায় কি কবে ? যে-সঙ্গীত থেমেছে অথচ যার রেশটুকু এখনও শরং-প্রভাতের স্নিগ্ধ স্পর্শের মতো স্মৃতি জাগাচ্ছে, সেসঙ্গীতের ছিন্নবিচ্ছিন্ন স্বরগুলিকে আবার গেঁথে তোলা যায় কি করে’ ? এমনি কতগুলো অস্পষ্ট প্রশ্নের উত্তরে আমার মধ্যে মুকুলিকা দেবীর পরিচয়লাভের আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে মাথা তুললে। আসলে তখন মনস্তত্ত্বের এমন বিশ্লেষণ করার অবসর ছিল কি না সন্দেহ, কিন্তু এইটে অত্যন্তই সত্য ছিল, যে, আমি যেন দু-বছর আড়াইবছর ধরে নিজের জন্যে একটা দায়িত্ব গড়ে তুলেছি আর সেটা হচ্ছে ঐ মুকুলিকা দেবীর সঙ্গে সাক্ষাং। অথচ ব্যাপারটি সহজ মোটেও নয়। আমাদের বাঙালীর সমাজে কোন অপরিচিত পুরুষের পক্ষে সম্পর্কলেশহীন পরিবারের কোন অনাত্মীয় মহিলার পরিচয় লাভ করবার কোন স্বযোগই নেই। আমাদের দুজনের লেখা একই মাসিক পত্রিকাতে গেঁরোয় শুদ্ধ এই ঘটনাটাই আর কিছু সামাজিক রীতিনীৰ্ত্তিক নাকচ করে দেবার দাবী নিয়ে দাড়াতে পারে না। সমাজের হাতে এমন কোন যন্ত্র নেই যা দিয়ে অস্তরের আত্মীয়তার সঠিক পরিমাপ করতে পারে রোমান্স \ుevరి এবং সেই-অনুসারে সামাজিক রীতিনীতিকে প্রয়োজনমত ডাইনে-বায়ে সরিয়ে দিতে পারে। সামাজিক রীতিনীতির উদ্ধত প্রাচীর এমনি একটা নিজীব ব্যাপার যে কোন স্বরের স্পৰ্শই তাকে বিন্দুমাত্রও চঞ্চল করে তোলে नीं । কিন্তু অপর পক্ষে মুকুলিকা দেবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ব্যাপারটা আমার কাছে যত কঠিন বলে মনে হ’তে লাগল এই সাক্ষাৎ করার বাসনাও তত প্রবল হ’য়ে উঠতে লাগল। আর সেই-সঙ্গেসঙ্গে ভবানীপুর বেলতলা রোডের “অশ্র-নিবাস” আমার কাছে একটা পরম রহস্তের আবাস হ’য়ে উঠল। “অশ্র-নিবাস” –কত সৌর্থীন লোকের কত বাড়ীর নাম শুনেছি। কতরকমের আবাস নিবাস নিকেতন ভিলা—কিন্তু এ-পর্যন্ত “অশ্রনিবাস বলে কোন নাম কোথাও শুনিনি। অশ্র-— এ কার অশ্র ?—কিসের অশ্রু ?—এ কি কোন ব্যক্তিবিশেষের জীবন-ব্যাপী দুর-বিগলিত অশ্র, না এই পুথিবীর থমকে-থাকা অব্যক্ত অশ্র ? কে এমন মাস্থ্যটি যে এমন দুঃখের সংজ্ঞা দিয়ে আপন আবাসস্থানকে ঘিরে রেখেছে ? কি এমন তার অন্তর-বেদনা যা এই পুথিবীর সহস্ৰ চাঞ্চল্য ভূলিয়ে দিতে পারেনি, জীবন-সংগ্রামের শত সহস্ৰ আশা-আকাঙ্ক্ষা হালকা করে তুলতে পারেনি ? কে সে এমন মানুষটি যার অন্তরে দুঃখের দেবতা এমনি স্থায়ী আপন পেতে বসেছেন, যে, এই পৃথিবীর সকলপ্রকার স্বথের স্বরই সেখান থেকে প্রতিহত হ’য়ে ফিরে আসে ; যে, সেখানে শরৎ-উষার মুগ্ধ প্রকৃতি, জ্যোৎস্না-যামিনীর স্বদূরের আমন্ত্রণ, বসন্ত-সন্ধ্যার একটা চির-অব্যক্ত আকুলত কোন নব চাঞ্চল্যই আর সত্য করে তুলতে পারে না ? ঐ যে রৌদ্র করে নারিকেল-শাখাগ্র ঝিল মিল করছে, বহুদূর থেকে একটা চিলের ডাক বাতাসে ভর করে ভেসে আসছে, গৃহ-পালিত পারাবতের বক-বকম্-কুৰ্ম্ম ক্ষণে-ক্ষণে শোনা যাচ্ছে, ঐ যে একটা মোটর-গাড়ী হরন বাজিয়ে তার কোন স্বদুর গন্তব্য স্থানে ছুটে গেল—এসব কি তার অন্তরে কোন নব স্বথ নবীন আকাঙ্ক্ষা দিয়েই ভরে দেয় না ? কোন কঠোর সমাপ্তির কঠিন রেখ। তার জীবন-কাহিনীতে দাড়ি টেনেছে ?
পাতা:প্রবাসী (চতুর্বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৬৬৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
![](http://upload.wikimedia.org/wikisource/bn/thumb/1/15/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80_%28%E0%A6%9A%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%82%E0%A6%B6_%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%97%2C_%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A5%E0%A6%AE_%E0%A6%96%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A1%29.djvu/page666-1024px-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80_%28%E0%A6%9A%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%82%E0%A6%B6_%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%97%2C_%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A5%E0%A6%AE_%E0%A6%96%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A1%29.djvu.jpg)