পাতা:প্রবাসী (চতুস্ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ ঐবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একাদশ পরিচ্ছেদ ९ লোচনদাসের আখড়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। কোন দিকে যাব তার কিছুই ঠিক নেই। বর্ষাকাল কেটে গিয়েছে, আকাশ নিৰ্ম্মল, শরতের শাদা লঘু মেঘখণ্ড নীল আকাশ ঘেয়ে উড়ে চলেছে, মণিহারী ঘাটের কাছে গঙ্গা পার হবার সময় দেখলুম গঙ্গার চরের কাশ-বনে কি অজস্র কাশফুলের মেলা ! থানিকট রেলে খানিকটা পায়ে হেঁটে এলাম কহলগীয়ে । গঙ্গার ধীরে নির্জন স্থানটি বড় ভাল লাগল। ষ্টেশনের কাছেই পাহাড়, সমূনে যে পাহাড়ট, তার ওপরে ডাক-বাংলা—এখানে একটা রাত কাটালাম । ডাক-বাংলার কাছে কি চমৎকার এক প্রকার বঠফুল ফুটেছে, জ্যোৎস্না রাত্রে তার সুগন্ধে ডাক-বাংলার বারীনা আমোদ ক’রে রেখেছে । এক দিন কহলগীয়ের খেয়াঘাটে শুনলাম ক্রোশখানেক দূরে গঙ্গার ধীরে বটেশ্বরনাথ পাহাড়ে এক জন সাধু থাকেন। একথান নৌকা ভাড়া ক’রে বেরিয়ে পড়লাম। বটেশ্বরনাথ পাহাড় দূর থেকে দেখেই আমার মনে হ’ল এমন সুন্দর জায়গা আমি কমই দেখেছি, এখানে শাস্তি ও আনন্দ পাব। গঙ্গার ধারে অনুচ্চ ছোট পাহাড়, পাহাড়র মাথায় জঙ্গল, নানা ধরণের বুনো গাছ, এক ধরণের হলদে পাপড়ি বড় বড় ফুল ফুটেছে পেয়ারাগাছের মত গাছে, নাম জানি নে । একটা বড় গুহা আছে পাহাড়ের দক্ষিণ দিকের ঢালুতে জঙ্গলের মধ্যে । গুহার মুখের কাছে প্রাচীন একটা বটগাছ, বড় বড় ঝুরি নেমেছে, ঘন ছায়া, পাকা বটফল তলায় পড়ে আছে রাশি রাশি। সাধুটির সঙ্গে আলাপ হ’ল, বাড়ি ছিল তার মাদ্রাজে, কিন্তু কথাবার্তায় চেহারায় হিন্দুস্থানী। সাধুটা খুব ভাল লোক, লম্বাচওড়া কথা নেই মুখ, বাঙালী বাবু দেখে খুব থতির করলেন । নিজে কাঠ কুড়িয়ে এনে চা ক'রে খাওয়ালেন, আমার সম্বন্ধে দু-একটা কথা জিগোল করলেন। বললেন, আপনি এধানে যত দিন ইচ্ছে থাকুন, এখানে খরচ খুব কম। আমি এর আগে মুঙ্গরে কষ্টহারিণীর ঘাটে ছিলাম, শহরবাজার জায়গা, এত খরচ পড়ত যে টিকতে পারলাম না। তাও বটে, আর দেখুন বাবুজী, সাধুরা চিড়িয়ার জাত, আজ এখানে, কাল ওখানে—এক জায়গায় কি ভাল লাগে বেশী দিন ? লোকজন বিশেষ নেই, স্থানটি অতিশয় নির্জন, কথা বলবার লোক নেই, তার প্রয়োজনও বোধ করি নে বর্তমানে— সারা দিনের মধ্যে সন্ধ্যার সময় সাধুজীর সঙ্গে বসে একটু আলাপ করি । এত দিন কোথাও যে-শাস্তি পাই নি, এখানে তার দেখা মিলেছে, এক দিন পাহাড়ের ওপরে বেড়াতে বেড়াতে জঙ্গলের মধ্যে একটা মুড়ি-পথ পেলাম। পাহাড়ের গা কেটে পথটা করা হয়েছে, ডাইনে উচু পাহাড়ের দেওয়ােলট, বায়ে অনেক নীচে গঙ্গা, চালুটাতে চামেলীর বন, একটা প্রাচীন পুষ্পিত বকাইন গাছ পথের ধারে । কিছু দূর গিয়ে দেখি, পাহাড়ের গায়ে খোদাই-করা কতকগুলো বৌদ্ধ দেবদেবীর মূৰ্ত্তি—গবর্ণমেণ্টের নোটিশ টাঙানো আছে এই মূৰ্ত্তিগুলো কেউ নষ্ট করতে পারবে না ইত্যাদি। আমি জানতাম না এদের অস্তিত্ব। জায়গাটা অতি চমৎকার, সুর্য্যাস্তের সময় সেদিন পীরপৈতির অনুচ্চ শৈলমালার ওপরের আকাশটা লাল হয়ে উঠল, গঙ্গার বুকে আকাশজোড়া রঙীন মেঘমালার ছায়া, খোদাই-করা দেবদেবীর মুক্তি গেধুলির চাপা আলোয় কেমন একটা অনির্দেশু শ্ৰী ধারণ করেছে—সে ঐ বড় অদ্ভুত, কোন মুৰ্ত্তির নাক ভাঙা, কোনটার হাত নেই, বেশীর ভাগ মুক্তিরই মুখ খসে গিয়েছে—কিন্তু গোধুলি রক্ত-পিঙ্গল আকাশের ছায়ায় যক্ষিণী যেন জীবন্ত হয়ে উঠল ; পাথরে কাটা পীন স্তনযুগল যেন রক্তমাংসের ব’লে মনে হ'ল, লুম্বিনী উদ্যানের ছায়াতরমুলে শায়িতা আসন্ন-প্রসব মায়া.দবীর চোখের পলক যেন পড়ে পড়ে--তায় পর চামেলীর বন কালো