পাতা:প্রবাসী (চতুস্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/১৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জ্যৈষ্ঠ ওকে সম্পূর্ণ অঙ্ক রকমের দেখায়, যে-কেউ দেখলেই বলতে পারে ও এ-গায়ের নয়, এ অঞ্চলের না-ও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। দুটে জিনিষ সীতা খুব ভালবাসে ছেলেবেলা থেকে— সাবান আর বই। আর এখানে এসে পৰ্য্যস্ত ঠিক ওই দুটে৷ জিনিষই মেলে না—এ-বাড়িতে সাবান কেউ ব্যবহার করে না, কাকীমাদের বাক্সে সাবান হয়ত আছে, কিন্তু সে বাক্সসাজানো হিসেবে আছে, যেমন তাদের বাক্সে কাচের পুতুল আছে, চীনেমাটির হরিণ, খোকা পুতুল, উট আছে— তেম্নি। তবুও সাবান বরং খুজলে মেলে বাড়িতে-কেউ ব্যবহার করুক আর নাই করুক –বই কিন্তু খুজিলেও মেলে না-দুখান বই ছাড়া—নতুন পাজি আর সত্যনারায়ণের পুথি। আমরা তে চা-বাগানে থাকৃতাম, সে তো বাংলা দেশেই নম্ন—তবুও আমাদের বাক্সে অনেক বাংলা বই ছিল । নানা রকমের ছবিওয়ালা বাংলা বই—যীশুর গল্প, পরিত্রাণের কথ, জবের গল্প, স্ববর্ণবণিক পুত্রের কাহিনী— আরও কত কি । এর মধ্যে মিশনরী মেমের অনেক দিয়েছিল, আবার বাবাও কলকাত থেকে ডাকে আনাতেন— গীতার জন্যে এনে দিয়েছিলেন কঙ্কাবতী, হাতেমতাই, হিতোপদেশের গল্প, আমার জন্তে একথান। ‘ভূগোল-পরিচয়’ বলে বই, আর একথানা ঠাকুরদাদার ঝুলি’ । আমি গল্পের বই পড়তে তত ভালবাসিনে, দু-তিনটে গল্প পড়ে আমার বইখানা আমি সীতাকে দিয়ে দিয়েছিলাম । আমার ভাল লাগে যিশু খৃষ্টের কথা পড়তে । পৰ্ব্বতে ষিপ্তর উপদেশ, যিশুর পুনরুত্থান, অপব্যয়ী পুত্রের প্রত্যাবর্তন —এ-সব আমার বেশ লাগে । এখানে ও-সব বই পাওয়া যায় না ব’লে পড়িনে । যিশুর কথা এখানে কেউ বলেও না। একখানা খৃষ্টের রঙীন ছবি আমার কাছে আছে— মিস্ নর্টন দিয়েছিল—সেখানা আমার বড় প্রিয়। মাঝে মাঝে বার ক’রে দেখি । হিন্দু দেবতার কোনো মূৰ্ত্তি আমি দেখিনি, জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে যা পূজো করেন, তা গোলমত পাথরের মুড়ি । এগ্রামে দুর্গাপূজা হয় না, ছবিতে দুর্গামূৰ্ত্তি দেখেছি, ভাল বুঝতে পারিনে, কিন্তু একটা ব্যাপার হংেচে মধ্যে । চৌধুরীপাড়ায় বড় পুকুর ধারের পাকুড়গাছের তলায় কালো পাথরের একটা দেবমূৰ্ত্তি গাছের গুড়িতে ঠেসানো দৃষ্টি-প্রদীপ ¥ማው আছে—আমি এক দিন দুপুরে একলা পাকুড়তলা দিয়ে যাচ্চি, বাবা তখন বেঁচে আছেন, কিন্তু তার খুব অস্থখ– ওই সময় মূৰ্ত্তিটা আমি প্রথম দেখি—জামুগাটা নির্জন, পাকুড়গাছের ডালপালার পিছনে অনেকখানি নীল আকাশ, মেঘের একটা পাহাড় দেখাচ্ছে ঠিক যেন বরফে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা-একটা হাতভাঙা যদিও কিন্তু কি স্বন্দর যে মুখ মুক্তিটার, কি অপূৰ্ব্ব গড়ন— আমার হঠাৎ মনে হ’ল ওই পাথরের মূৰ্ত্তির পবিত্র মুখের সঙ্গে ক্রুশবিদ্ধ যীশুখৃষ্টের মুখের মিল আছে– কেউ ছিল না তাই দেখেনি—আমার চোথে জল এল, আমি একদৃষ্টিতে মূৰ্ত্তিটার মুথের দিকে চেয়েই আছি— ভাবলাম জ্যাঠামশায়রা পাথরের মুড়ি পূজো করে কেন, এমন সুন্দর মূৰ্ত্তির দেবতাকে কেন নিয়ে গিয়ে পূজো করে না ? তার পরে শুনেছি ওই দীঘি খুড়বার সময়ে আজ প্রায় পচিশ বছর আগে মূৰ্ত্তিটা হাত-ভাঙা অবস্থাতেই মাটির তলায় পাওয়া যায়—সীতাকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলাম একবার—একবার সীতা জবা, আকন্দ, ঝুম্কো ফুলের একছড়া মালা গেঁথে মূৰ্ত্তির গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। অমন মুন্দর দেবতাকে আজ পচিশ বছর অনাদরে গ্রামের বাইরের পুকুরপাড়ে অমন ক’রে কেন যে ফেলে রেথে দিয়েছে এরা ! একবার একখানা বই পড়লাম— বইখানার নাম চৈতন্যচরিতামৃত । এক জায়গায় একটি কথা প’ড়ে আমার ভারি আনন্দ হ’ল । চৈতন্যদেব ছেলেবেলায় একবার আঁস্তাকুড়ে এটো হাড়িকুড়ি যেখানে ফেলে, সেখানে গিয়েছিলেন বলে তার মা শচীদেবী খুব বকেন। চৈতন্যদেব বললেন– মা, পৃথিবীর সৰ্ব্বত্র ঈশ্বর আছেন, এই অঁাস্তাকুড়েও আছেন । ঈশ্বর যেখানে আছেন, সে-জায়গা অপবিত্র হবে কি ক’রে ? ভাবলাম জ্যাঠাইমাদের বিরুদ্ধে চমৎকার যুক্তি পেয়েছি ওঁদের ধর্মের বইম্বে, চৈতন্তদেব অবতার, তারই মুখে । জ্যাঠাইমাকে একদিন বললাম কথাটা । বললাম—“জ্যাঠাইম, আপনি যে বাড়ির পিছনে বঁাশবনে গেলে কি শেওড়া গাছে কাপড় ঠেকলে হাত-পা না খুক্ষে, কাপড় না ছেড়ে ঘরে ঢুকতে দেন না, চৈতন্যচরিতামৃতে কি লিখেছে জানেন ?” চৈতন্যদেবের সে-কথাটা বলবার সময়ে জানন্দে মন আমার ভরে উঠল— এমন নতুন কথা, এত স্বাক্ষর কথা আমি কখনও গুনিনি । ভাবলাম জ্যাঠাইম বই পড়েন না বলে এত মুন্দর কথা যে