পাতা:প্রবাসী (চতুস্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/২০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আচাৰ্য্য নন্দলাল বসু ও র্তাহার চিত্রকলা ক্রমণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত মনে পড়িতেছে অনেক বছর আগে কোন একটা বাংলা দৈনিক কাগজে এক ব্যঙ্গচিত্র ও ব্যঙ্গকবিতা দেখিয়াছিলাম ; বিষয় ছিল “রাষ্ট্ৰী পক্ষী নিরীক্ষণ করিতেছেন”। মনে পড়িতেছে কবিতাটা যেন এরূপ— “রংবেরঙের অগ্নিকণা হাত দুটো ঠিক সাপের ফণা মৎস্যকন্যা কিম্ব নারী সেইটি বোঝা শক্ত ভারি।” সে দিন বোধ হয় আজ চলিয়া গিয়াছে। রাস্তায় যখন বাহির হই, চারিদিকে দেখি দেওয়ালে পোষ্টার ; সাবান, এসেন্স, তেলের বিজ্ঞাপন। মাসিকপত্রে নানা চিত্র—সবটাতেই “তথাকথিত” ভারতীয় শিল্প চুকিয়া বসিয়াছে। "তথাকথিত” বলিলাম, কেন-ন ভারতীম শিল্পের রূপ সম্বন্ধে নানা আলোচনা চলিতে পারে। সরিষাপড়া দিয়া ভূত তাড়ান হয়, কিন্তু সরিষার ভিতর যদি ভূড ঢুকিয় বসে, তবে ভূত তাড়াইবার উপায় কি ? আমার এই উক্তি একটা উদাহরণ দিয়া বুঝাইয় দিই । বোম্বে স্কুল অব আর্ট নিজের স্বাতন্ত্র্যে চলে ; বাংলার নয়। পদ্ধতির অমুসরণ করে না । কিন্তু সেখানকার শিল্পীরাও বলিয়া থাকেন ষে তাহারাও ভারতীয় শিল্পের “রেনেসা” বা পুনরভু্যদয় সংঘটন করিতেছেন । ১৯২৯ সনে বোম্বে স্কুল অব আর্ট পরিদর্শন করি। তথায় ভারতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন যুগের কয়েকটি সিম্বলিক্যাল চিত্ৰ দেখি—তাহার একটি গুপ্ত-যুগের চিত্র। একটি মেয়ে সোজা দাড়াইয়া, গ্ৰীক মূৰ্ত্তির স্থায় নিখুঁত গডন, কিন্তু পোষাক-পরিচ্ছদ অজণ্টার মত, পিছনে আবার পরীর মত ডান আছে । অজণ্টার পোষাক থাকা সত্ত্বেও ছবিখানি গুপ্তযুগ অপেক্ষ বিলাতের ভিক্টোরিয়া যুগের “প্রির্যাফেলাইট" আর্টিষ্ট—রসেটি, ওয়াটস, বা বাৰ্ণ জোনস প্রমুখ শিল্পীদের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছিল। ছবিখানির সবই বুঝিলাম, ম্যানাটমি ঠিক হইয়াছে, কোনো চিত্রপরিচয়ের দরকার নাই ; কিন্তু অজন্টার পোষাকটা যেন বিসদৃশ লাগে—এ যেন সরিষার ভিতর ভূতের প্রবেশ । গুপ্ত যুগের আবহাওয়া যদি সত্যই আনিতে হয়, তবে কিরূপ মূৰ্ত্তি হইবে ? “মুথে তার লোধ রেণু লীলাপদ্ম হাতে, কৰ্ণমূলে কুম্বকলি, কুরুবক মাথে তমুদেহে রক্তাম্বর নীবিশ্বন্ধে বাধা, চরণে নুপুরথানি বাজে আধা আধা ।” অথবা "কার্য সৈকতলীন হসমিথুন স্রোতবহামালিনী পাদাস্তমণ্ডিতো নিমগ্নহরিশ গৌরীপ্তরে: পাবনাঃ শাখালম্বিত বন্ধলস্য চ তয়ে নিৰ্ম্মতুমিচ্ছাম্যম্বঃ • শৃঙ্গে কৃষ্ণমৃগস্য বামনয়ন কণ্ড রমানাং মৃগীম, ।" এবং কুন্তু ন কর্ণাপিত বন্ধন সথে শিরীষমাগন্তু বিলম্বী কেশরমনব শরচ্চন্দ্র মরীচি কোমলং মৃণালস্ত্ৰং রচিতং স্তনান্তরে ( শকুন্তল! ) গুপ্ত-যুগের আদর্শ চিত্র করিতে গিয়া বোম্বাইয়ের শিল্পী অজণ্টার আভরণখানি লইয়াছেন, তার স্পিরিট বা প্রাণ ধরিতে পারেন নাই । শিল্পের সেই প্রাণ কোথায় ? বিশেষ ধরণে কাপড়-পরানোতে এবং অলঙ্কারে ? শিল্পের এই প্রাণটুকু ধরিতে পারিলে শিল্পের ভাষা বোঝা হইল। বাংলায় যে ভারতীয় শিল্পের পুনরভু্যদয়, তার উৎপত্তি ক্লাসিক্স হইতে । ক্লাসিকাল ভারতীয় শিল্প ও সাহিত্য হইতে তাহার প্রেরণা। কিন্তু যদি কেহ শুধু ক্লাসিক্স লইয়া থাকে, তার মন পঙ্গু হইয়া যাইতে পারে । নন্দলালের কাজে ক্লাসিকাল মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ক্লাসিকাল ভারতকে তিনি তার শিল্পে যেমন ব্যক্ত করিয়াছেন, অন্য কেহই তেমনটি করেন নাই। তাহা সত্বেও নন্দলাল ক্লাসিকস-এ বদ্ধ হইয় থাকেন নাই, প্রকৃতি বা বর্তমানকে উপেক্ষা করেন নাই । তাম্রাভ বালুকার উপরে গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরের রৌদ্র, তার মধ্যে তালপাতার ক্ষুদ্র এক সবুজ শীষ মাথা তুলিয়াছে, যেন মরকত মণি জলিতেছে । আচার্ষ্য বস্থ মহাশয় তার এক ছাত্রকে বলিতেছেন, “দেখ, তালপাতার সবুজ পাতাটুকু যেন আগুনের ফুলকি, এ যদি আঁকা যায় এরই দাম হবে লাখ টাকা : এ ছবি কম কি ? বুদ্ধ কি শিবের ছবি থেকে এ কম হবে কেন ?”