পাতা:প্রবাসী (চতুস্ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8>ა® মানুষ অন্যান্য জীবজন্তুর সঙ্গে সমান, মানুষের সহজাত মুরুচির জ্ঞান ব্যবহারিক জগতেও সেই সব প্রয়োজনের ক্ষেত্রগুলিকে অন্য মানুষের চোখে পড়তে দিতে কুষ্ঠিত হয়। সুতরাং শিল্প বা সাহিত্যের উদ্ধতর লোকে সেগুলির অবিকল প্রতিরূপ খুব স্পষ্ট করে তুলতে মানুষের কুষ্ঠিত হওয়াই স্বাভাবিক। পূৰ্ব্বেই বলেচি, সাহিত্য সমাজের একটা অবিকল প্রতিচ্ছবি নহে, তাহা বিভিন্ন শিল্পীর বিভিন্ন আদর্শ অনুযায়ী রচিত সমাজের সুসংযত এবং সুসমঞ্জস রূপমূৰ্ত্তি। তাই সাহিত্য সমাজকে হুবহু নকল করার চেষ্টায় বার-বার পথভ্রান্ত হয়েচে । এক শ্রেণীর সাহিত্যিক জোরগলায় বলচেন, সাহিত্য সমাজের অবিকল প্রতিরূপ, সমাজে ভালমন্দ যেখানে যা যেমন ঘটচে সাহিত্যেও ঠিক তেমনিষ্ট তার প্রতিচ্ছবি না থাকলে সাহিত্য একদেশদর্শী হয়ে ওঠে, তার সৌন্দর্য্যের ত্রুটি এবং বিস্তারে বাধা থেকে যার । এক্ষেত্রে বলবার কথা এই যে, আদিযুগ থেকে আজ পর্য্যন্ত সৰ্ব্বদেশের সাহিত্যিকই নিজ নিজ দেশের সাহিত্যে সমাজের ভালমন্দ দুটো দিকের ছবিই দেখিয়েচেন, তবে তাদের মধ্যে অধিকাংশই অবশ্য শেষপর্য্যস্ত ভালটাকে উজ্জ্বলবর্ণে চিত্রিত করে গেছেন। ভারতীয় সাহিত্যের আদিকবি বাল্মীকি উচ্চস্থলতার যে-চিত্র রাবণের ভিতর দিয়ে দেখিয়েচেন, তা কোন দেশের কোনও বাস্তব উচ্চ স্থল চরিত্রের চাইতে উচ্ছঙ্খলতায় বিশেষ কম যায় না। কিন্তু রামায়ণ পড়ে বাল্মীকির রাবণ-চরিত্র জীবনে অনুকরণ করতে বোধ হয় কেহই ইচ্ছুক হয় না, কারণ শিল্পীর রচনা-কৌশলে রামায়ণে কল্যাণের রূপ অকল্যাণের রূপকে পরাভূত ক’রে ফুটে উঠেছে। আর একটা কথা, সমাজের হুবহু নকল সাহিত্যে অঙ্কন করবার শক্তিই বা ক-জন সাহিত্যিকের থাকতে পারে বা আছে । সমস্ত সমাজের সর্বাঙ্গে একই সময়ে চোখ রেখে সাহিত্যস্থষ্টি করাই কি সহজ কথা ! অল্পজ্ঞ অক্ষম শিল্পীরা অন্ধদের হস্তিদর্শনের মত সমাজের বিভিন্ন অঙ্গের রূপ দেখে অন্যান্য অঙ্গের সঙ্গে সমস্ত দেহটার সঙ্গে তাদের সম্বন্ধ না জেনে ( অন্ধর যেমন তর্ক তুলেছিল হস্তি দড়ির মত, না খামের মৃত্ত, না কুলার মত, তেমনই ) একই সমাজের বাস্তব চিত্র আঁকতে গিয়ে কেঞ্জিকে নীরস নীতিকথার সাহিত্য, শ্রাবার কেহ বা তাকৈ বুপ্তি-সাহিত্য করে প্তপ্রবচনস্ট ఏరి8ు তোলেন। দক্ষ শিল্পী চক্ষুষ্মান ব্যক্তির মত এককালে সমাজের সর্বাঙ্গ দেখতে পান এবং সেই জন্যই তার হাত দিয়ে সমাজের যে-রূপ সাহিত্যে ফুটে ওঠে তার মধ্যে রাম রাবণ সীতা সুর্পনখা সকলেরই স্থান আছে । অধিকন্তু সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য কবির সৌন্দৰ্য্যজ্ঞান ও কল্যাণবুদ্ধির স্পশ আছে । এইখানেই বড় সাহিত্যিকের ও ছোট সাহিত্যিকের রচনার প্রভেদ | এর পর সাহিত্যসাধনার পথ সম্বন্ধে দু-এক কথা ব’লে আমার বক্তব্য শেষ করব । রবীন্দ্রনাথ এই পথের নির্দেশ দিতে গিয়ে শিল্প-সাধনার অন্তরের কথা বলেছেন, “দেখ, দেখ, দেখ”—প্রকৃতি ও সমাজকে সত্যদৃষ্টি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করা সাহিত্যিকের প্রথম প্রয়োজন, তার বর্ণশিক্ষা ও ব্যাকরণ-জ্ঞান না-থাকলে সে যেমন বাহিরের দিক দিয়ে সাহিত্যস্থষ্টি করতে কোন দিনই সক্ষম হবে না, তেমনই অস্তরের দিক দিয়ে যে নিজে দেখেনি সে পরকে দেখাতে কোন দিনই সক্ষম হবে না। এক্ষেত্রে আরও একটা কথা জানবার আছে, আমরা যে কেবল বৰ্ত্তমানকে দেখব তা নম, আমরা অতীত ও বর্তমানকে এককালে দেখবার সাধনা করব । অতীতের সাহিত্যশ্রষ্টার যা রেখে গেছেন ত৷ আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তি, আমাদের যাত্রাপথের অবশুপ্রয়োজনীয় পাথেয়—তা যেন আমরা ভুলে না যাই । এ-কথা যেন মুহূর্তের জন্যও না ভুলি যে মানুষের শিক্ষা ও সভ্যতা সম্ভব হয়েচে মানুষ জন্মমাত্র তার পূর্বপুরুষদের যুগযুগ-সঞ্চিত জ্ঞান অতীতের উত্তরাধিকার-স্বরূপ পেয়েচে বলে। নূতনত্বের মোহে আমরা তুচ্ছ জিনিষটাকে নিয়ে মাতামতি করতে গিয়ে বড় জিনিষটাকে ভুলে যাই, কবির ভাষায় মাথাটা সহজাত বলে, তার মূল্য বুঝি না, পাগড়ীট সংগৃহীত বলে এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে তাকে সম্মান দিই। কিন্তু চিরদিন ঘরে বসে পৈত্রিক সম্পত্ত্বি খরচ করলে যেমন দৈন্ত আসে এবং বিনাশ আসে, তেমনই চিরদিন পূৰ্ব্বতন লেখকদের ভাব ও ভাষার চৰ্ব্বিভচৰ্ব্ব করলেও সাহিত্যের দৈন্ত ও অধঃপতন অনিবাৰ্য্য। পৈত্রিক সম্পত্তিকে কারবারে থাটাতে হবে, বৰ্ত্তমানের সঙ্গে অতীতের যোগসাধন করতে হবে। এই নিজের উপার্জন প্রকৃতিকে এবং সমাজকে ভালবেসে নিজের চোখে দেখে তার কাছ থেকে রূপ রসের