পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নিরঞ্জন বলিল, “বেশ ত ভাল কথা। তবু যদি কোনো কথাই ওঠে, তাহলে বলে যে ও কণ্ট গয়না তুমিই ভাইকিকে পরিয়ে দিয়েছ। যা তোমার স্বামীর পাওনা নয়, সে বিষয়ে এটুকু বলতে তোমার ভয় হওয়া উচিত নয় ।” কল্যাণী স্তন্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। এ-কথার উত্তর তাহার মনে স্পষ্ট থাকিলেও মুখে সে কিছু উচ্চারণ করিতে পারিল না। তাহার নীরবতায় নিরঞ্জনই লজ্জা পাইয়া যেন কৈফিয়তের স্বরে বলিল, “দেখ, মেয়েটার বারো বছর বয়স হ’ল, আজ বাদে কাল বিয়ে দিতে হবে । অথচ তার জন্তে গয়না টাকা কিছুই ত করে রাখতে পারিনি। যে কটা টাকা ছিল মার কাজে সব খরচপত্র হয়ে গেল ; একটা দায় উদ্ধার হতে গিয়ে অন্ত দায়ে যে একেবারে জড়িয়ে পড়লাম। বাড়িতে সস্তান বলতে ত ঐ একটি। তোরও আর নেই, আমারও নেই। ওর বিয়েতে তুই যদি ক’খান গয়না দিস পিসির মত কাজ হয় না কি ? আমার একলার সামর্থ্যে ওর ভাল বিয়ে কি আর হবে ?” নহরপুরের সম্বন্ধটা ত গহনার অভাবেই ভেঙে যাবে মনে হচ্ছে ।” কল্যাণী বলিতে পারিল না “আজ গয়ন কটা দাও । বিয়ের সময় আমি পরিয়ে দিয়ে যাব।” সে শুধু বলিল, “মার কাজের আগে যদি দাদা, এ কথাগুলো বলতে ত সকল দিক দিয়ে সহজ আর স্বন্দর হত। এত লোকজানাজানি হয়ে পড়ত না।” নিরঞ্জন বলিল, “হীরালাল তোকে বেশ পার্থীপড়া করে সব মুখস্থ করিয়েছে দেখছি। ঠাকুরমার গহনা নাতনীকে পরিয়ে দিলে মহাপাপ হয় কি-না, তাই লোক জানাজানি হলে সমাজে আর কেউ মুখ দেখাতে পাবে না ?” নিরঞ্জন আর না দাড়াইয়া মুখ অন্ধকার করিয়া বোঝাই নৌকার মত ছলিতে দুলিতে আপনার বিপুল দেহুভার টানিয়া বাহির হইয় গেল, দরজা পার হইতে হইতে একবার মুখ ফিরাষ্টয়া শেষ অস্ত্র ছাড়িয়া গেল, “তোমার সতীনের গুটির ভোগের জন্তই আমার মা এত সখ করে গয়না গড়িয়েছিলেন দেখছি।” ভোরের আলো ভাল করিয়া ফুটে নাই। গাড়ীবারান্দ ঢাকা ফুটপাথগুলির উপর তখনও খাটিয়া-মাছর কিম্বা শুধু و این বাধা পাতিয়া দোকানী পদারী গাড়োয়ান কুলি প্রভৃতির দল নিজা দিতেছে। কল্যাণী মোটর হইতে আপনার দরজায় নামিল। তাহার জ্ঞাতি দেবর সদর দরজাটা খুলিয়া বলিল, “কি বৌদি, কাক কোকিল না ডাকৃতে বাপের বাড়ি ছেড়ে দৌড়, কিছু সরিয়ে আনলে নাকি?” কথার উত্তর না দিয়া শুধু মৃদ্ধ হাসিয়া কল্যাণী ক্ষিপ্ৰপদে আপনার উপরের ঘরে চলিয়া গেল। হীরালালের সদ্য পরিত্যক্ত শয্যা পড়িয়া আছে । সে এই মাত্র উঠিয়া বাহির হইয়াছে বোধ হয়। চকিত দৃষ্টিতে চারিধারে চাহিয়া কল্যাণী আঁচলের চাবি দিয়া লোহার সিন্ধুকটা পুলিয়া ফেলিল, গহনার বাক্সট তাহার ভিতর সস্তপণে রাখিল এবং মায়ের হাতের লেখা ফর্দটা বাহির করিয়া চাবি বন্ধ করিম দিল। ফৰ্দটা হাতে করিয়া তাহার দিকে দৃষ্টিপাত করিতেই চোখের জলের বড় বড় ফোট তাহার উপর ঝরিয়া পড়িল । কল্যাণী ফৰ্দটা মাথায় ঠেকাইয়া বুকে চাপিয়া তারপর তাহ ফুটি কুটি করিয়া ছিড়িয়া পথের দিকের জানাল দিয়া ফেলিয়া দিল । তারপর উনানের ধোয়ার ইসারার ডাকেও নয়, কলতলায় ঝিয়ের বাসন নামানোর ঝঙ্কারেও নয়, শুধু শুধু কেন যে কল্যাণী ব্যস্ত হইয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল বোঝা গেল না। পথের মাঝখানে হীরালালের সহিত দেখা । “কি গো, কখন এলে ? গয়নাগাটিগুলো রাখলে কোথায় ?” কল্যাণী চোখ না তুলিয়াই বলিল, “দাড়াও, উনানের আঁচটা দিয়ে নি আগে, কালকের বাসি দুধটুধগুলো পড়ে আছে, তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে সব ছিড়ে নষ্ট হয়ে ; যাবে।” হীরালাল বলিল, “ঝি এসে আগুন দেবে এখন, তোমার আবার ঘুটে কমলা ঘাটুতে যাওয়া কেন ? তার চেয়ে চল না জিনিষ কটা দেখি । ঠিকঠাক ক’রে রাখতেও ত হবে। আমাদের যা বাড়ি যেখানে সেখানে ফেলে রাখা চলবে না।” কল্যাণীকে প্রায় টানিয়াই হীরালাল উপরে লইয়া চলিল । ঘরের ভিতর ঢুকিয়াই দরজাটা হুড়ক দিয়া বন্ধ করিয়া বলিল, “সবাই এখনও ওঠেনি ; এর পর আর দিনের আলোয় ঘরে দোর দেওয়া চলবে না, এই বেলা ওপাটটা চুকিয়ে ফেলা ভাল।" . - - সিন্মুক খুলিয়া কল্যাণী গহনার বাক্স বাহির ক্ষরিল,