পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

খাসিয়া ও জয়ণ্ডিয়া পাহাড় এবং কাৰাখা । ... . • সভ্যতা ছিল সেটি ধর্থের চাপে একেবারে পিষ্ট হয়ে গেছে। এখনও এদের মধ্যে বহু উপকথার প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। সে গল্প এত দীর্ঘ যে, একবার বলতে স্বরু করলে রাত কাবার হয়ে যেতে পারে। তার বর্ণনা-চাতুর্ঘ্য যেমন মনোরম তার ঘটনা-বিন্যাসও তেমনি হৃদয়গ্রাহী। ' এই সব গল্প এবং উপকথা থেকে এই আন্দাজ করা সম্ভবপর যে, খাসিয়াদের এককালে একটি বিশিষ্ট সাহিত্যিক চিস্তার ধারা এবং হয়ত সাহিত্যও ছিল। কিন্তু সে-সব এখন লুপ্তপ্রায়। এই জাতির মধ্যে শ্ৰীযুত শিবচরণ রায় একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি । তিনি ভগবদগীতা খাসিয়া ভাষায় অনুবাদ করেছেন এবং ভারতের কালচার এবং সভ্যতা সম্পর্কে অনেকগুলি বই নিজের ভাষায় লিখেছেন। কিন্তু আর কেউ এই কাজ করেন নি, যদিচ এখন তাদের মধ্যে শিক্ষিত স্ত্রী-পুরুষের অভাব নেই । মোট কথা, আমার বক্তব্য এই যে, যে-ভাযায় ভগবদগীতার শ্লোক অনুদিত হতে পারে সে-ভাষার অস্তনিহিত শক্তিকেও অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু উৎসাহ এবং চর্চার অভাবে এই ভাষা এতদিন পুষ্টিলাভ করতে পারে নি। চেরাপুঞ্জি এবং শেলাপুঞ্জির রামকৃষ্ণ মিশন যদি এই কাজে একটু মনঃসংযোগ করেন তাহলে খাসিয়া ভাষা তথা খাসিয়া সাহিত্যের যথেষ্ট প্রসার হতে পারে। পাঠকদের কৌতুহল পরিতৃপ্তির জন্যে এখানে এক থেকে দশ পৰ্য্যন্ত যথাক্রমে খাসিয়া সংখ্যাবাচক শব্দ লিখচি : --‘ওয়ে অথবা শি", আর, লাই, সাও, সান, ইন্দ্রেও, নিট, ফ্র, খাগুই, শিফাউ। আমি চেরাপুঞ্জিতে একটি খাসিয়-পরিবার দেখতে গিয়েছিলুম-গৃহস্বামীর নাম এলজিকিশোর রায়। এ-নাম যে বাংলা আৰ্যকিশোর থেকে উদ্ভূত তা বোধ হয় আন্দাজ করা যেতে পারে। গৃহস্বামী আমাদের চা এবং ভিজে চিড়ে ও চিনি দিয়ে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন। র্তার অনেকগুলি ছেলে—তাদের নাম ব্রডার, টেণ্ডার, মণ্ডার, ইনভেড়ার ইত্যাদি। এই নাম-নিৰ্ব্বাচনেও খ্ৰীষ্টীয় প্রভাব । কেন-ন, নিজস্ব কোন ঐতিহ্য এদের মনে নেই। ছেলেগুলি সকলেই ওখানকার রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে পড়ে। তাদের উপাধি কিন্তু রায় নয়, মায়ের উপাধি অনুযায়ী ব্রডার ডলিং ইত্যাদি। গৃহস্বামী নিজে এবং স্ত্রী, পুত্র এবং স্ত্রীর মাকে নিয়েই এই পরিবার গঠিত। ইনি ঐহট্ট অঞ্চলে ব্যবসা করেন, স্বতরাং বাংলা জানেন, কিন্তু সে বাংলার সঙ্গে আমাদের পশ্চিম প্রদেশীয় বাংলা মেলে না। অতএব মিঃ রায়ের সঙ্গে আমার মন খুলে আলাপ করার স্ববিধা হ’ল না, রামকৃষ্ণ মিশনের একজন কৰ্ম্ম-মধ্যস্থ হয়ে তার বাংলা আমাকে এবং আমার বাংলা তাকে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন কিন্তু এলজিকিশোরের ফৰ্ম্মালিটি-বিহীন ‘তুই’ সম্বোধন সেদিন আমার খুব মিষ্টি লেগেছিল। আকৃতি, প্রকৃতি এবং চিন্তার প্রণালী দিয়ে বিচার করতে গেলে খাসিয়াদের সঙ্গে বাঙালীর খুব মিল দেখতে পাওয়া যায়। এখনও ও-জাতি বিদেশীদের খুব পক্ষপাতী, বিশেষ করে বাঙালীর। এর কারণ এই যে, এক সময়ে বাঙালীদের সঙ্গে এদের রক্তের মিশ্রণ হয়েছিল। এই পাৰ্ব্বত্য জাতি যখন লুঠতরাজ করে বেড়াত তখন শ্রীহট্ট, কাছাড় প্রভৃতি অঞ্চল থেকে মেয়ে ধরে এনে এরা বিয়ে করেছিল। যাদের বংশে এই বাঙালী রক্তের মিশ্রণ আছে তারাই এখনও কুলীন—তাদের উপাধি জাইড খার। চেরাপুঞ্জির যিনি সিম বা রাজা তিনি বাঙালীর মতই ধুতি পরেন এবং ধুতিই তার দরবারের পোষাক । খাসিয়াদের নামের কোন বৈশিষ্ট্য নেই আগেই বলেছি, কিন্তু জগদীশ’ প্রভৃতি বাঙালী নামও তাদের আছে দেখেছি। রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম শ্রেণীর একটি ছাত্রের নাম আগে ছিল ‘বিথ গ্যান – ওঁরা তার সংস্কৃত বা বাংলা রূপ দিয়েছেন "বেদজ্ঞান’ । হিন্দুধৰ্ম্ম এবং হিন্দুসভ্যতা এখনও বিকৃতভাবে বেঁচে আছে জয়স্তিয়া পাহাড়ের নাৰ্ত্তিয়াং বলে একটি গ্রামে । এই গ্রামটি চারিপাশে পাহাড় দিয়ে ঘের, বাইরের সভ্যতা থেকে একেবারে বিচ্ছিল্প। এই গ্রামখানি শিলঙের জোয়াই মহকুমার অন্তর্গত। শিলং থেকে জোয়াই ৩৩ মাইল এবং জোয়াই থেকে নাৰ্বিমাং তের-চৌদ্ধ মাইল। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে উচুনীচু সরু পথ-ঘোড়ার পিঠে চড়ে কিংবা হেঁটে ভিন্ন যাতায়াতের আর কোন যানবাহন নেই। শুনেচি শিলং থেকে শ্ৰীহট্ট পৰ্যন্ত যে নতুন মোটরের পথ খোলা হমেচে তার থেকে এ জায়গাটা কাছে পড়বে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্ঘ্যের বিষয় এই যে, পৰ্ব্বতবেষ্টিত এই ক্ষুদ্র গ্রামের মন্দিরের পূজারী একজন বাঙালী। উৰে