খলক্তিব্য অনেক করিয়া বধূকে সে ঠাণ্ডা করিল। খন খন, ভা-ভস্, মাটি ঝরিয়া পড়িতেছে। ছোট সরু জানালা, তাহারই নীচে সি ধ কাটিতেছে। অন্ধকারের মধ্যে অনেকক্ষণ তাকাইতে তাকাইতে দৃষ্টি খুলিয়া গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া দেবীদাস জানলার পাশে বসিয়া আছে। ক্রমে গৰ্ত্ত কাটা হইয়া গেল। খানিকক্ষণ চুপচাপ, তারপর একটা কাল মাথা সিধের মুখে ভিতরে আসিতেছে। বধু ব্যস্ত হইয়া আঙুল দিয়া দেখাইল—ঐ– চুপ—বলিয়া দেবীদাস তাহাকে থামাইয়া দিল। বলিল —মানুষ নয়, ও লাঠির মাথায় কাল হাড়ি। আগে ঐ পাঠিয়ে পরখ করে কেউ পাহারা দিয়ে বসে আছে কি-না। চুপ চুপ— হঁাড়ি ঘরের মধ্যে অনেকখানি আসিয়া এদিকে-ওদিকে নড়িয়া চড়িয়া আবার বাহির হইয়া গেল । আবার চুপচাপ । তারপর দেখা গেল, অতি সন্তপণে গৰ্ত্তের আলগা মাটির উপর দিয়া ধীরে ধীরে আগাইয়া আসিতেছে সত্যকার মাথা। অন্ধকারে দেবীদাসের মুখে তীক্ষ হাসি থেলিয়া গেল। চোর আর একটু আসিতেই তাহাকে জাপটাইয়া ধরিয়া হে হে করিয়া সে হাসিয়া উঠিল । নিতাস্ত ছেলেমানুষ চোর, একেবারে ডাক ছাড়িয়া কাদিয়া উঠিল--আমি কিছু জানিনে ঠাকুরমশাই, আমায় ওরা ঠেলে পাঠিয়েছে- আমি নতুন লোক - -–ওর কারা ? সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল জন দুই-তিন দাওয়া হইতে উঠানে লাফাইমা পড়িল । দেবীদাস হাসিয়া বলিল-যা হতভাগা বেকুব বেল্লিকআর কাদিসনে, যা চলে--- বলিয় দোর খুলিয় তাহাকে ঠেলিয়া দিয়া পলায়মান একটি আবছা মূৰ্ত্তি লক্ষ্য করিয়া দেবীদাস ছুটিল। বাড়ির সীমা ছাড়াইয়া বিল। লোকটি ছুটিতে ছুটিতে বিলে গিয়া পড়িল । শুকনার সময়, বিলে জল-কাদার সম্পর্ক নাই। দেবীদাস তীরের মত ছুটিয়াছে। কাছাকাছি আসিয়া বলিল---আর পালাবি কতদূর ? বিলে এসেই যে ভুল করলি, বেকুব গাধা কোথাকার। এখানে গ-ঢাকা দিবি কোথায় ? জেৰীদাল রায়ের সিন্দুক \&?→ কিন্তু সে ভাবনা ভাবিবার আগেই চোর একটা উচু আল বাধিয়া পড়িয়া গেল। দেবীদ্বাস কাছে আসিয়া পড়িল, কিন্তু গায়ে হাত দিল না । বলিল—এখন ধরব না-ওঠ বেটা, ছোটু— শেষে তুই ভাববি, পড়ে না গেলে দেবীদাস রায় ধরতে পারত না- * লোকটি কিন্তু উঠিল না, পড়িয়া পড়িয়াই কাতরাইতে লাগিল। পড়িয়া গিয়া তাহার প। ভাণ্ডিয়াছে। অতএব দৌড়িয়া ধরিবার বাসনা স্থগিত রাথিয় দেবীদাস আপাতত চোরকে কাধে করিয়া আসিল। দিন তিনেক ধরিয়া স্বামিস্ত্রীতে বিস্তর তদ্বির করিয়াতাহাকে খাড়া করিয়া তুলিল । একদিন বধু জিজ্ঞাসা করিল—কি মতলবে এসেছিলি বাবা ?—জানিস্ত আমরা ভিখিরী বামুন— , অনেক রকমে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া জানা গেল, এদেশে গুজব রটাছে--দেবীদাস রায় বিবাহ করিয়া সিন্দুক ভরিয়া বিস্তর টাকা আনিয়াছে। লোভে পড়িয়া অনেকে তাই নিশিরাতে এই বাড়ি ইটাইটি করে— বধু বলিল- টাকা নয়, সোনার তাল। সিন্দুকে সোনার গাছ আছে --তাল তাল সোনার ফলন হয় ..সে আমি দেখাব না ত—কিছুতেই না । তারপর মৃদ্ধ হাসিয়া সিন্দুকের ডাল উচু করিয়া তুলিয়া ধরিল। অগণিত তালপাতার পুথি । তাহারই কয়েক বোঝ! তুলিয়। উন্টাইয়া পাণ্টাইয়া সিন্দুকের ভিতর দেখাইল । অজস্র পুথি, তা ছাড়া আর কিছু নাই। বধু বলিল-আমার বাবা মস্ত বড় সাৰ্ব্বভৌম পণ্ডিত, মরবার সময় সিন্দুক-বোঝাই এই সব ধনরত্ন দিয়ে গেছেন—এর এক টুকরা আমি কাউকে দিতে পারব না বাপু— এক বছরের আগ-পাছ স্বামী-স্ত্রী অপুত্ৰক মরিলেন। দেবীদাসের স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি সহায়রামে বৰ্ত্তাইল । সহায়রামের পৈতৃক তেজারতির কারবার ছিল ; কিন্তু এক দুরারোগ্য রোগে সমস্ত মাটি করিয়া দিল, সহায়রাম পাল লিখিতেন— যাত্রার পাল, কীৰ্ত্তন-কথকতার পালা—দুইকানে যাহা শুনিতেন, পালায় বাধিয়া বসিয়া থাকিতেন । বন্ধকী কাগজ-পত্র অন্দরে গিরির বাক্সে তালাবন্ধী হইয়া থাকিত, দেবীদাস রায়ের সিন্দুকটি কেবল সহায়রামের নিজস্ব সম্পত্তি— ওটি থাকিত বাহিরের চণ্ডীমণ্ডপে। ভোরবেলা সকলের
পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৫৯
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।