কাত্তিক এবং যে কুসংস্কার স্থচিত করিত, শত বৎসরের শিক্ষার ফলে তাহা কতটা বিদূরিত হইয়াছে, তাহার হিসাব করা কৰ্ত্তব্য। ইংরেজ যখন এদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন তখন এদেশে নানাপ্রকার আত্মবলি এবং নরবলি-প্রথা প্রচলিত, ছিল। যেমন ধর্ণ, গঙ্গাসাগরে পুত্র বিসর্জন, গঙ্গাজলে আত্মবিসর্জন, শিশুকন্যা হত্য, সতীদাহ, স্ত্রীকে স্বামীর শবের সহিত জীবন্ত অবস্থায় মাটিতে পুতিয়া ফেলা ইত্যাদি। ধর্ণ অর্থ কোন ব্যক্তির অপর কাহারও উপর কোনও দাবি থাকিলে বা দাবি করিবার ইচ্ছা থাকিলে, সেই দাবিদারের কোনও অস্ত্র কিংবা বিষ হাতে করিয়া অপর পক্ষের বাড়ির দ্বারে গিয়া উপবাস আরম্ভ করা, এবং দাবি পূরণ না হইলে প্রায়োপবেশন করিয়া বা বিষ খাইয়া বা অস্ত্রাঘাতে আত্মহত্য করা । সেকালে কোনও দাবিদার এইরূপে ধর্ণ দিলে অপর পক্ষও উপবাস আরম্ভ করিত এবং তাহার বাড়িতে । লোকের যাতায়াত বন্ধ হইত। ১৭৯৫ সালের ২১ কান্তন ( Regulation ) পাস করিয়া সরকার কাশীর ব্রাহ্মণগণের আচরিত ধর্ণ এবং এই শ্রেণীর অন্যান্য আচরণ দণ্ডনীয় করিয়াছিলেন, এবং বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ধর্ণ নিবারণের জন্ম সালের ৫ কামুন পাস করিয়াছিলেন । ১৮০২ সালের ৬ কামনে গঙ্গাসাগরে এবং গঙ্গার আর কয়েকটি ঘাটে পুত্রবিসর্জন দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়৷ বিহিত হইয়াছিল। এই সকল অনাচার হিন্দুর দ্বারা অনুষ্ঠিত হইলেও ইহাদিগকে প্রকৃত হিন্দু সভ্যতার অঙ্গ বলা যাইতে পারে না, কেননা হিন্দুর প্রামাণ্য শ্রীতি-স্মৃতি-পুরাণের বচনে ইহাদের বিধি নাই। সকল দেশেই সভ্যতার পশ্চাতে একটা বর্বরতার ছায়া থাকে। যেমন ইউরোপে ডাইনি ( witch ) দাহ করা । বৈজ্ঞানিকেরা সভ্যতার সঙ্গে বিজড়িত বৰ্ব্বরতার অবশিষ্টকে বলেন folk-lore, লোকশাস্ত্র । পুহবিসর্জনের মত প্রথা শাস্ত্রে বিহিত হয় নাই । এইগুলি দেশাচার, লোকাচার বা স্থলবিশেষে কুলাচার মূলক। স্বতরাং সরকার আইন করিয়া এই সকল অনাচার রহিত করিয়া দিতে কোন সঙ্কোচ বোধ করেন নাই। কেন না এই সকল অনাচার নিবারণের ফলে শাস্ত্রে বিধিবদ্ধ হিন্দুধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করা হয় না। কিন্তু যে ר כף צ শক্ত বৎসর পরে r. $ সকল वडि-निदक ( Digest ) অনুসারে সেকালের আদতের পণ্ডিতগণ ব্যবস্থা দিতেন, সেই সকল নিবন্ধে স্ত্রীর মৃতপতির অনুগমনের বা সতীদাহের বিধান ছিল। স্বতরাং সতীদাহ নিবারণ করা কৰ্ত্ত কি-না, এই বিষয়ে ইংরেজ রাজপুরুষগণের বিশেষ সন্দেহ ছিল। সুপ্রীম কোর্ট কলিকাতা শহরে সতীদাহ নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন। কলিকাতার অধিবাসীরা শহরের বাহিরে গিয়া সতীদাহ সম্পাদন করিত। বাংলাবিহারের শাসনভার গ্রহণ করিয়া অনেক দিন পর্যন্ত সরকার কলিকাতা শহরের বাহিরে সতীদাহ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিতে সাহস করেন নাই। গভর্নর-জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলী ১৮০৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে লিখিত একখানি চিঠিতে নিজামত আদালতকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিঙ্গ, কিরূপ সহমরণ হিন্দুশাস্ত্রসম্মত। এই চিঠির উত্তরে নিজামত আদালতের জজের আদালতের পণ্ডিতগণের ব্যবস্থা লইয়া ঐ সালের ৫ই জুন তারিখে উত্তর দিয়াছিলেন, গর্ভবতী, ঋতুমতী, নাবালিকা বা শিশুসন্তানবতী বিধবার সহমরণ শাস্ত্রসম্মত নহে, এবং মাদক দ্রব্য খাওয়াইয়া কোন বিধবাকে সহমরণে ব্ৰতী করাও কৰ্ত্তব্য নহে। নিজামত আদালতের এই উত্তর পাওয়ার অনতিকাল পরেই (৩১শে জুলাই ) লর্ড ওয়েলেসলী পদত্যাগ করিয়াছিলেন । স্বতরাং তিনি সতীদাহ সম্বন্ধে কোন ব্যবস্থাই করিয়৷ যাইতে সমর্থ হন নাই। ইহার সাত বৎসর পরে, ১৮১২ সালে, এবং তারপর ১৮১৫ এবং ১৮১৭ সালে সরকার নিজামত আদালতের উপদেশমত ম্যাজিষ্ট্রেটগণের উপর আদেশপত্র পাঠাইয়া কোন কোন বিধবার সহমরণ নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন। ১৮১৮ সালে কয়েক জন হিন্দু এই সকল আদেশ-পত্র প্রত্যাহার করিবার জন্য সরকারের নিকট আবেদন করিয়াছিলেন। রামমোহন রায়ের উদ্যোগে এই আবেদনের বিরুদ্ধে আর কয়েক জন হিন্দু একটি পাল্ট আবেদন পাঠাইয়াছিলেন । এই পাণ্টা আবেদনের ব্যবস্থা করিয়া রামমোহন রায় সতীদাহের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছিলেন, এবং এই ১৮১৮ সালেই “সহমরণ বিষয়” প্রথম পুস্তিক প্রকাশ করিয়াছিলেন। হিন্দুশাস্ত্রে দৃঢ়বিশ্বাসী রামমোহন রায় কেন যে সতীদাহ নিবারণে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিলেন, এই পুস্তিকার নিম্নোঙ্কত কয়েক ছত্র পাঠ করিলেই তাহা বুঝিতে পারা যাইবে— ‘ - -
পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৭৩
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।