আখড়াইয়ের দীঘি ষ্ট্র তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক বৎসর পর পর আজন্মার উপর সে বৎসর নিদারুণ অনাবৃষ্টিতে দেশটা যেন জলিয়া গেল। বৈশাখের প্রারম্ভেই অন্নাভাবে দেশময় হাহাকার উঠিল । রাজসরকার পর্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। সভাই দুর্ভিক্ষ হইয়াছে কি-না তদন্তের জন্য রাজকর্মচারী-মহলে ছুটাছুটি পড়িয়া গেল। এই তদন্তে কান্দী সাবডিভিসনের কয়টা থানার ভার লইয়া ঘুরিতেছিলেন রজত শৰু ডি, এস, পি, স্বরেশবাবু ডেপুট, আর রমেন্দ্রবাবু কো-অপারেটিভ ইন্সপেক্টর। অতীত কালের স্বপ্রশস্ত বাদশাহী সড়কটা ভাঙিয়া-চুরিয়া গে-পথের মত মানুষের অব্যবহার্ঘ্য হইয়া উঠিয়াছে। তাহার উপর ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের ঠিকাদার মাটির ঢেল বিচাইয় পথটিকে আরও দুর্গম করিয়া তুলিয়াছে । কোনরূপে তিন জনে এক পাশের পায়ে চলা পথবেথার উপর দিয়া বাইসিক্ল ঠেলিয়। চলিমাছিলেন । বৈশাখ মাসের অপরাধুবেল। বিদগ্ধ আকাশখান ধূলাচ্ছন্ন ধূসর হইয়া উঠিয়াছে। কোথাও কণামাত্র মেঘের রেশ নাই। হু হু করিয়া গরম বাতাস পৃথিবীর বুকের রস পৰ্য্যন্ত যেন শোষণ করিয়া লইতেছিল। একখানা গ্রাম পার হইয়া সম্মুখে এক বিস্তীর্ণ প্রান্তর আসিয়া পড়িল। ওপ্রান্তের গ্রামের চিহ্ন এ-প্রান্ত হইতে দৃষ্টিতে ধরা দেয় না । দক্ষিণে বামে শস্তহীন মাঠ ধৃ ধূ করিতেছে। গ্রামের চিহ্ন বহু দূরে গিয়ে কালির ছাপের মত বোধ হইতেছিল। রঙ্গতবাবু চলিতেছিলেন সর্বাগ্রে। তিনি ডাকিয়া কহিলেন-নামছি আমি। আপনার ঘাড়ের উপর এসে পড়বেন না যেন। তিন জনেই বাইসিক্ল হইতে নামিয়া পড়িলেন। সঙ্গীরা কোন প্রশ্ন করিবার পূৰ্ব্বেই তিনি বলিলেন—কই মশাই, সামনে গ্রামের চিহ্ন যে দেখা যায় না। এদিকে দিবা যে অবসানপ্রায় । রমেন্ত্রবাবু কোমর কুলান বাইনাকুলারটা চোখের উপর ধরিয়া কহিলেন-দেখা যাচ্ছে গ্রাম, কিন্তু অনেক দূরে । অন্ততঃ পাঁচ-ছ মাইল হবে। রজতবাবু রিঃওয়াচটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন---পেনে ছট। এখনও আধ ঘণ্টা তিন কোয়াটার দিনের আলো পাওয়া বাবে। কিন্তু এদিকে যে বুক মরুভূমি হয়ে উঠল মশাই। আমার ওয়াটার ব্যাগে ত এক বিন্দু জল আর নেই। আপনাদের অবস্থা কি ? রমেন্দ্রবাবু কহিলেন—আমারও তাই। স্বরেশবাবু, আপনার অবস্থা কি ? আপনি যে কথাও বলেন না, দৃষ্টিটাও বেশ বাস্তব জগতে আবদ্ধ নয় যেন। ব্যাপার কি বলুন ত? স্বরেশবাবু মৃদু হাসিয়া বলিলেন--সত্যিই বর্তমান জগতে ঠিক মনটা নিবদ্ধ ছিল না। অনেক দূর অতীতের কথা ভাবছিলাম আমি । রজতবাবু সাগ্রহে বলিয় উঠলেন—অতীত যখন তখন ইণ্টারেটিং নিশ্চয়, চাই কি রোমাটিকও হতে পারে । তৃষ্ণানিবারণের জন্য আর ভাবতে হবে না। উঠে পড়ুন গাড়ীতে। গাড়ীতে চলতে চলতেই আপনি গল্প বলতে স্বর করুন। আমরা শুনে যাই । কিন্তু এই চার-পাচ মাইল পথ কভার করবার মত গল্পের খোরাক হওয়া চাই মশায় ! স্বরেশবাবু আপনার জলাধারটি খুলিয়া আগাইয়া দিয়া বলিলেন-- আমার জল এখনও আছে । আপনার জল পান করে একটু স্বস্থ হন আগে। t জলপানাস্তে স্বরেশবাবুকে সৰ্ব্বাগ্রে স্থান দিয়া রজতবাবু বলিলেন-আপনি কথক। আপনাকে আগে যেতে হবে। সকলে গাড়ীতে চড়িয়া বসিলেন। মুরেশবাবু বলিলেন—আপনাদের জলের চিস্তার কথা শুনেই কথাটা আমার মনে পড়ল । পিছন হইতে রমেন্ত্রবাবু হাকিলেন—দাড়ান মশাই দাড়ান। বাঃ আমাকে বাদ দিয়ে গল্প চলবে কি রকম ?...বেশ এইবার কি বলছিলেন বলুন। একটু উচ্চকণ্ঠে কিন্তু । স্বরেশবাবু বলিলেন—যে রাস্তাটায় চলেছি আমরা . এ রাস্তাটার নাম জানেন? এইটেই অতীতের বিখ্যাত ।
পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৭৭
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।