পাতা:প্রবাসী (ত্রয়স্ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৮৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ ঐবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়ই আমি আর সীতা কার্ট রোড ধ'রে বেড়াতে বেরই। আমাদের বাগান থেকে মাইল দুই দূরে একটা ছোট ঘর আছে, আগে এখানে পোষ্ট আপিস ছিল, এখন উঠে যাওয়াতে শুধু ঘরটা পড়ে আছে-উমুল্লাঙের ডাক-রাণার ঝড়-বৃষ্টি বা বরফপাতের সময়ে এখানে মাঝে মাঝে আশ্রয় নেয় । এই ঘরটা আমাদের ভ্রমণপথের শেষসীমা, এর ওদিকে আমরা যাই না যে তা নয়, কিন্তু সে কালেভদ্রে, কারণ ওখান থেকে উস্প্লাং পৰ্যন্ত খাড়া উৎরাই নাকি এক মাইলের মধ্যে প্রায় এগারো-শ ফুট নেমে গিয়েচে মিস নটনের মুখে গুনেচি–যদিও বুঝিনে তার মানে কি। আমাদের অত দূর যাওয়ার প্রয়োজনও ছিল না, যা আমরা চাই তা পোষ্ট আপিসের ভাঙা ঘর পর্য্যস্ত গেলেই যথেষ্ট পেতাম— দ্বধারে ঘন নির্জন বন—আমাদের বাগানের নীচে গেলে আর সরলগাছ নেই—বনের তলা আর পরিষ্কার নেই, পাইন বন নেই, সে বন অনেক গভীর, অনেক নিবিড়, যেমন দুষ্প্রবেশু তেমনি অন্ধকার, কিন্তু আমাদের এত ভাল লাগে । বনের ফুলের অস্ত নেই– শীতে ফোটে বুনো গোলাপ, গ্রীষ্মকালে রডোড়েগুন বনের মাথায় পাহাড়ের দেওয়ালে লাল আগুনের বন্ত আনে, গায়ক পার্থীরা মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে চারিধারের নির্জন বনানী গানে মুখরিত করে তোলে— ঝর্ণ শুকিয়ে গেলে আমরা শুকনো ঝর্ণর পাশের পথে পাথর ধরে ধরে নীচের নদীতে নামতাম—অতি সন্তৰ্পণে পাহাড়ের দেওয়াল ধীরে ধরে, সীতা পেছনে, আমি আগে । দাদাও এক-একদিন আসতো—তবে সাধারণতঃ সে আমাদের এই-সব ব্যাপারে যোগ দিতে ভালবাসে না । এক-একদিন আমি একাই আলি। নদীর খাতটা অনেক নীচে—তার পথ পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে নীচে নেমে গিয়েচে-যেমন পিছল, তেমনি দুর্গম—নদীর খাতে একবার পা দিলে মনে হয় যেন একটা অন্ধকার পিপের মধ্যে ঢুকে গিয়েচি-দুধারে খাড়া পাহাড়ের দেওয়াল উঠেচে—জল তাদের গা বেয়ে ঝরে পড়চে জায়গায় জায়গায়—কোথাও অনাবৃত, কোথাও গাছপালা, বনফুল লতী—মাথার ওপরে আকাশটা যেন নীল কার্ট রোড-ঠিক অতটুকু চওড়, ঐ রকম লম্বা, এদিকে ওদিকে চলে গিয়েচে, মাঝে মাঝে টুকরো মেঘ কার্ট রোড বেয়ে চলেচে, কখনও বা পাহাড়ের এ-দেওয়াল ও-দেওমাল পার হয়ে চলে যাচ্ছে— মেঘের ওই খেলা দেখতে আমার বড় ভাল লাগত-নদীখাতের ধারে একখানা শেওলা ঢাকা ঠাণ্ডা পাথরের ওপর বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখ উচু করে চেয়ে চেয়ে দেখতাম -- বাড়ি ফিরবার কথা মনেই থাকৃত না । মাঝে মাঝে আমার কি একটা ব্যাপার হত । রকম নির্জন জায়গায় কতবার একটা জিনিষ দেখেচি ... হয়ত দুপুরে চা-বাগানের কুলীরা কাজ সেরে সরল গাছের তলায় খেতে বসেচে—বাবা ম্যানেজারের বাংলাতে গিয়েচেন, সীতা ও দাদা ঘুমুচ্চে—আমি কাউকে না জানিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে কার্ট রোড ধ'রে অনেক দূরে চলে যেতাম—আমাদের বালা থেকে অনেক দূরে উন্মুল্লাঙের সেই পোড়ো পোষ্ট আপিস ছাড়িয়েও চলে যেতাম-পথ ক্রমে স্বত নীচে নেমেচে, বন জঙ্গল ততই ঘন, ততই অন্ধকার, লতাপাতায় জড়াজড়ি ততই বেণী-বেতের বন, বাঁশের বন মুরু হত— ডালে ডালে পরগাছা ও অর্কিড় ততই ঘন, পার্থী ডাকত— সেই ধরণের একটা নিস্তন্ধ স্থানে এক গিয়ে বসতাম। চুপ করে বসে থাকতে থাকৃতে দেখেচি অনেক দূরে পাহাড়ের ও বনানীর মাথার ওপরে নীলাকাশ বেয়ে যেন আর একটা পথ—আর একটা পাহাড়শ্রেণী—সব যেন মৃত্ন হুলুদ রঙের আলো দিয়ে তৈরি—সে অন্ত দেশ, সেখানেও এমনি গাছপাল, এমনি ফুল ফুটে আছে, হলুদ আলোর বিশাল জ্যোতিৰ্গম পথটা এই পৃথিবীর পর্বতশ্রেণীর ওপর দিয়ে শুষ্ক ভেদ করে মেঘরাজ্যের ওদিকে কোথায় ওই