পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৫০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6 * 8 প্রবাসী—মাঘ, ১৩৩৭ [ ৩eশ ভাগ, ২য় খণ্ড হয়েছে।” ঠিক এই কথাগুলি একেবারেই তাহার মনের কথা নয়, কিন্তু মায়াকে আর কি সে বলিতে পারে ? মায়া বলিল, “বাবার কথা শুনব ? হিন্দুর ছেলে হয়ে আপনি আমাকে জাত ধৰ্ম্ম সব খোয়াতে বলেন ? এর চেয়ে বিপদ আর আমার কি হ’তে পারে ? সাধে কি বেহায়ার মত বেরিয়ে এসেছি ?” প্রভাস চুপ করিয়া রহিল। ভয়ে এবং অস্বস্তিতে তাহার প্রায় নিশ্বাস রোধ হইয়া আসিতেছিল। কি করিয়া ইহাকে ফিরান যায় ? মায়াকে ভালবাসিয়া, শেষে সে-ই কি তাহার নামে একটা মিথ্যা কলঙ্কের স্থষ্টি করিবে ? এখানে বাঙালীর সমাজ যে কিরূপ তাহী সে জানে না, কিন্তু দেশের সমাজ সম্বন্ধে তাহার অভিজ্ঞতা উত্তম রকমই ছিল। সেখানে এই ধরণের কথা প্রচার হইলে তাহার ধে কি অর্থ দাড়াইত, তাহাও সে জানে । খানিকক্ষণ ভাবিয়া বলিল, “তুমি বাড়ী ফিরে যাও মায়, এমন সময় এখানে আসা তোমার উচিত হয় নি। লোকে শুনলে নিন্দ করবে।” মায়া বলিল, “করুক গে। আপনি কথা দিন আমাকে ঐ ব্যারিষ্টারের হাত থেকে বাচাবেন, তা ন৷ হ’লে আমি যাব না।” প্রভাস আমুনয়ের স্বরে বলিল, “আমাকে কেন এর ভিতর জড়াচ্ছ, মায়া ? আমি ত কাল চলে যাচ্ছি, আমায় যেতে দাও, মিথ্যা তোমার নামে একট। অপবাদ স্বষ্টি করতে দিও না মানুষকে ।” মায়া কাদিয়া ফেলিল। ঘাসের উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল, “আমি যাব না, আমি কিছুতেই যাব না।” দূরে এই সময় মোটরের হর্ণ তীব্রম্বরে বাজিয়া উঠিল। দুইখানা গাড়ী দ্রুতবেগে ছুটিয়া আসিতেছে দেখা গেল । একটা অগ্রসর হইয়া চলিয়া গেল, একটা মায় এবং প্রভাসের খানিকদূরে পথের উপর আসিয়া দাড়াইল । মায় বলিল, “ঐ আমাকে ধরতে আসছে। আমি কি করব ?” প্রভাস হতাশভাবে বলিল, “করুবার কিছুই নেই, ওদের সঙ্গে যাও। আমার যা করবার তা আমি করব।” গাড়ী হইতে নামিয়। একজন লোক দ্রুতপদে তাহাদের দিকে আসিতেছে দেখা গেল। প্রভাস চিনিল, দেবকুমার । পৃথিবীর আর যে-কোনো মানুষকে দেখিলে এই সময় প্রভাসের কিছু কম অপ্রতিভ লাগিত, কিন্তু দেবকুমারকে দেখিয়া সত্যই তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল হ্রদের জলে ঝাপ দিয়া পড়ে। দেবকুমার তাহাকে কি যে মনে করিতেছে, তাহা বুঝিতে তাহার বাকি রহিল না। সে নিজে হইলেই কি অন্য কিছু মনে করিত ? ধ্বকমাত্র ভগবানের চক্ষে সে নির্দোয, কিন্তু মানুষের কাছে নিজের নিদোষিত সে কিছুতেই প্রমাণ করিতে পারিবে না। দেবকুমার নিকটে আসিয়া তীব্র শ্লেষের স্বরে বলিল, “বেশ জমিয়ে তুলছিলেন, কিন্তু আমার কথাটা বোধ হয় ধৰ্ত্তব্যের মধ্যে আনেন নি, তাই প্লটুটা মাটি হয়ে গেল।” প্রভাস কি যেন বলিতে গেল, কিন্তু তাহার গলা দিয়া স্বর বাহির হইল না । দেবকুমার বলিয়া চলিল, “আইনত: আমি এখনও আপনাকে শাস্তি দিতে পারি না, যদিও মর্যালি আমার অধিকার স্বামীর অধিকারেরই সমান। কিন্তু মায়ার সামনে কিছু করতে চাই না, পরে আপনার সঙ্গে বোঝাপড়া করা যাবে । মায়, এস।” দেবকুমারকে দেখিয়াই মায়া উঠিয় দাড়াইয়াছিল । তাহাকে ডাকিবামাত্র সে চীৎকার করিয়া লেকের দিকে ছুটিয়া গেল এবং মুহূৰ্ত্ত মাত্রের মধ্যেই জলে ঝাপাইয় পড়িল । প্রভাস এবং দেবকুমার দুইজনেই জলে নামিয় পড়িল । দেবকুমার মিনিট খানিক পরে মায়ার অচেতন দেহ বহন করিয়া উঠিয়া আসিল । তারার আলোয় ঝু কিয়া পড়িয়া তাহার মুখ দেখিবার চেষ্টা কুরিল, ব্যাকুলভাবে ডাকিল, “মায়া, মায় !" মায়া সম্পূর্ণ অচেতন, দেবকুমারের ডাকে কোনো সাড়া দিল না। নিজের বলিষ্ঠ বাস্থতে তাহাকে উঠাইয়া লইয়া দেবকুমার মোটরের দিকে দ্রুতবেগে চলিয়া গেল, প্রভাসের দিকে আয় ফিরিয়াও চাহিল স । প্রভাস কিছুক্ষণ অন্ধকারে একলা দাড়াইয়া রহিল। তাহার দুই চোখ অপমানে ও বেদনায় জলে ভরিয়া উঠিল। অন্ধকারেই কোথায় যে সে মিশিয়া গেল, তাহাকে আর দেখা গেল না। ক্রমশঃ