পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৬৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পদ্মিনী উপাখ্যান ও তাহার ঐতিহাসিকতা ঐকালিকারঞ্জন কানুনগো, এম-এ, পি-এইচ, ডি সমগ্র রাজপুতানায় এবং উত্তর-ভারতে, বিশেষতঃ বঙ্গের ঘরে ঘরে, হিন্দু মুসলমান, শিক্ষিত অশিক্ষিত, নিৰ্ব্বিশেষে চিতোর-লক্ষ্মী পদ্মিনীর নাম সুপরিচিত। শিক্ষিত বাঙালী টড-রচিত রাজস্থানের ইতিহাস (১৮২৯ খৃঃ), কিংবা কবি রঙ্গলালের পদ্মিনী উপাখ্যান’ পড়িয়া চমৎকৃত হইবার অনূ্যন দেড়শত বৎসর পূর্ব হইতেই বাংলার নিরক্ষর মুসলমানগণ কবি আলাওলের “পদাবতি পুথি” শুনিয়া সন্ধ্যায় কৰ্ম্মক্লাস্ত শ্রাস্ত জীবনের অবসাদ ভুলিয়া আসিতেছে। সম্রাট শের শা’র রাজত্বকালে মুসলমান কবি ও সাধক মালিক মহম্মদ জায়সী ৯৪৭ হিজরীতে ( ১৫৪০ খৃ: ) অযোধ্যা প্রদেশের কথিত-হিন্দী ভাষায় ‘পদ্মাবত’ কাব্য রচনা আরম্ভ করেন। আলাউদ্দীন খিল্জীর চিতোর-অধিকার (২৬ আগষ্ট, ১৩০৩) হইতে জ্যায়সীর কাব্য-রচনার কাল পর্য্যস্ত ২৩৭ বৎসরের মধ্যে কোনো কাব্য বা ইতিহাসে পদ্মিনীর উল্লেখ আছে বলিয়া অদ্যাবধি জানা যায় নাই । কিন্তু পদ্মাবত রচনার পর হইতে এই কাব্যের বহুল প্রচারে এবং বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের ফলে উত্তর-ভারতের নিভৃত পল্লীতেও পদ্মিনী উপাখ্যান প্রচারিত হইয় পড়িয়াছে। সপ্তদশ শতাব্দীর সপ্তম পাদে রোসাঙ্গ বা আরাকানের রাজসভায় মন্ত্রী মাগন ঠাকুরের অনুরোধে চট্টগ্রাম জেলার ফতেয়াবাদ-নিবাসী আলাওল বাংলা ভাষায় পয়ার ছলে জ্যায়লীর হিন্দী “পৃদ্মাবত” অনুবাদ করেন। একালে ইংরেজীতে না লিখিলে তাহা যেমন সহজে সমগ্র ভারতের শিক্ষিত সমাজ গ্রহণ করিতে পারেন না, মোগল-যুগেও তেমনি ফাসী ভাষায় লিখিত না হইলে, ‘খুলাসাৎ-উৎ-তবারিখ’ প্রণেতা সুজান রায় ভাণ্ডারীর মত “শিক্ষিত” হিন্দুরাও মহাভারত, হরিবংশ বুঝিতে অক্ষম ছিলেন। হিন্দী ভাষা কিঞ্চিৎ দুৰ্ব্বোধ্য হওয়ায় ১৬৫২ খৃষ্টাকে রায় গোবিন্দ মুনশী পদ্মাবত-কাব্য ফাসী ٭ سسہ:اسb গদ্যে অনুবাদ করিয়াছিলেন ; ইহার নাম "তুহফাত-উলকুলুব । এই উপাখ্যান অবলম্বনে কবি হোসেন গজনবী “কিস্সা-ই-পদ্মাবত’ নামক ফাসী কাব্য লিখিয়া গিয়াছেন। ১৭৯৬ খৃষ্টাব্দে মীর জিয়াউদ্দীন ও গোলাম আলী পদ্মাবত-কাব্য উর্দু, কবিতায় অনুবাদ করেন । - - কালক্রমে অলীক জনশ্রুতি ও মনোরম কবিকল্পনা ইতিহাসে পরিণত হইয়াছে, ইহা আমরা প্রায়ই দেখিতে পাই । আবার কোথাও বিস্মৃতপ্রায় প্রকৃত ইতিহাসের ক্ষীণধারা জনশ্রুতির পঙ্কিল প্রবাহে মিলিত হওয়ায় অনাদৃত অবস্থায় রহিয়াছে। ইতিহাস মানব-সমাজের ‘বায়েং-উল-মাল’ বা সাধারণ কোষাগার ; ইহার অক্ষয় ও অফুরন্তু ভাণ্ডারের উপর দার্শনিক, চিত্রকর, কবি, কথা-শিল্পী, সকলেরই সমান অধিকার । ইহাদের সকলকেই ইতিহাসের দ্বারস্থ হইতে হইয়াছে, ইতিহাসও ইহাদের হাঞ্জে পড়িয়া ফলপ্রস্থ ও সমৃদ্ধিসম্পন্ন হইয়াছে। দার্শনিক হিমালয়ের উচ্চ গিরিশৃঙ্গ হইতে বা তাহার অপেক্ষ উচ্চতর চিস্তাসোপান হইতে পৃথিবীর বক্ষে মহাকালের তাণ্ডব নৃতা—শুধু মানুষে মানুষে নয়, জাতিতে জাতিতে নয়, মহাদেশের সহিত মহাদেশের, প্রাচ্যের সহিত পাশ্চাত্যের সংঘর্ষ দেখিয়া থাকেন। সাধারণ ঐতিহাসিক হয়ত শুধু অসির ঝনৎকার, পশুবলের সংঘর্ষ দেখিতে পান ; কিন্তু দার্শনিকের দৃষ্ট স্বল্পতর—তিনি দেখিতে পান যে, পরম্পর যুধ্যমান পশুবলের পশ্চাতে সভ্যতা ও চিন্তাধারার শাশ্বত বিরোধ রহিয়াছে। পুরাবৃত্ত ও দর্শনের মিলনে আমরা ইতিহাসবৃক্ষের সৰ্ব্বোত্তম ফলস্বরূপ রাষ্ট্র-বিজ্ঞান পাইয়াছি। কিন্তু দার্শনিকের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাহার একটি কোকিলের ডাক শুনিয়াই কান্তিককে চৈত্র জ্ঞান করেন। চোখ খুলিয়া হেমন্ত-সন্ধ্যার ঘন কুঙ্কটিকা দেখিবার