পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨ প্রবাসী—রৈশাখ, ১৩৩৭ [ ৩০শ ভাগ, ১ম খণ্ড আর লুকাইতে পারে না। র্তাহার অনেক পরে মারাঠারা বিভিন্ন প্রদেশে আধিপত্য বিস্তার করিয়া প্রায় সমগ্র মুঘল-সাম্রাজ্যের ন্যায্য রাজশক্তিকে ছাইয়া ফেলিয়া পিষিয়া মারে। পতনের এই সব জাজল্যমান প্রমাণ যখন দেখা দেয় নাই, অর্থাৎ আওরংজীব চক্ষু বুজিবার পূৰ্ব্বেই, মুঘল-রাজশক্তি দেউলিয়া হইয়া পড়িয়াছে ; ভাণ্ডারে টাকা নাই, বাহিরে থ্যাতি নাই, শাসকগণ অক্ষম হতভম্ব, সৈন্যগণ পরাজিত ; এত বড় সাম্রাজ্য আর একত্র বাধিয়া রাখা অসম্ভব ; একথা বিজ্ঞ লোকেরা তখনই বুঝিতে পারিলেন । আওরংজীবের রাজত্বকালেই মারাঠা জাতি নিজশক্তি দেখাইয়া স্বাধীনভাবে খাড়া হইল ; শিখগণ ধৰ্ম্মসম্প্রদায়ের রূপ ছাড়িয়া সৈনিক দলে গঠিত হইয়া দেশের রাজার বিরুদ্ধে লড়িতে লাগিল । অর্থাৎ, অষ্টাদশ শতাব্দী এবং মধ্য-উনবিংশ শতাব্দীতে যে দুই দেশীয় শক্তি ভারতইতিহাসের রঙ্গভূমিতে প্রধান নেতা হইবার চেষ্টা করে, তাহারা এই যুগেই প্রথম দেখা দিয়াছিল । এই যুগেই "মুঘলের অৰ্দ্ধশশী” বাড়িয়া বাড়িয়া পূৰ্ণকলার চরমে পৌছে,আবার এই রাজার অধীনেই তাহ ক্ষয় হইতে আরম্ভ করে । এই রাজত্বকালেই ভারতের ভাবী ভাগ্য-বিধাতার প্রথম এদেশে স্থায়িভাবে আডিডা গাড়েন ; জীর্ণ পীত অস্তাচলগামী মুঘলচন্দ্রের বিপরীত দিকে ভারত-গগনে ব্রিটিশের অরুণ-রাগ অতি সূক্ষ্ম ক্ষীণ রেখায় দেখা দেয় । বম্বে মাদ্রাজ এবং কলিকাতা এই যুগে ব্রিটিশের হাতে আসে এবং প্রধান কুঠা (প্রেসিডেন্সী) ও দুর্গে পরিণত হয়। দেশীয় রাজাদের পক্ষে তাহা দখল করা অসম্ভব হয়। এই কুঠার বেষ্টনীর মধ্যে যে দেশী লোকদের শাসন ও দেশী রাজাদের সহিত দৌত্যের কাজে বিদেশী বণিকগুলি এই সময় হাতেখড়ি আরম্ভ করেন, তাহাই কালক্রমে বিশাল ব্রিটিশ ভারতীয় শাসনযন্ত্রে পরিণত হইয়াছে । সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে মুঘল-সাম্রাজ্য প্রকৃতই খুন-ধর, অন্তঃসারশূন্ত জীবনহীন হইয়া পড়িয়ছিল। ধনবল জনবল লোপ পাইয়াছে, রাজ্যের অঙ্গগুলি পৃথক হইয়া খসিয়া পড়িতে উদ্যত। আর, নৈতিক অবনতিও পুরুষকারের • পরাজয় । ততোধিক ; প্রজার৷ আর রাজাকে ভয়ভক্তি করে না, রাজকৰ্ম্মচারীর ভীরু ও চোর, মন্ত্রীবর্গ ও রাজকুমারগণের কাহারও ধীরবুদ্ধি চরিত্র বা কাৰ্য্যকুশলতা নাই, সেনাগণ হীনবল হতাশ । কেন এমন হইল ? সম্রাট নিজে ত একজন মহাপুরুষ, র্তাহার কোন নেশা, অলসতা বা নিৰ্বদ্ধিতা ছিল না । আওরংজীবের বিদ্যাবুদ্ধির খ্যাতি সারা মুসলমান-এসিয়া ছড়াইয়া পড়িয়ছিল ; অপর লোক যেরূপ আগ্রহে বিলাসভোগে লাগিয়া যায়, তিনি সেইরূপ আগ্রহে সেইরূপ উৎসাহুে শাসনকার্য্যে নিজের সমস্ত সময়, সমস্ত মন ঢালিয়া দিয়াছিলেন । কোন . নিম্নতন কেরাণীও দিনের পর দিন এই বাদশাহের অপেক্ষ অধিক পরিশ্রম করিত না। আওরংজীবের চরিত্রে অসীম সহিষ্ণুতা, একনিষ্ঠত, শৃঙ্খলা ও নিয়ম রক্ষা করিবার আগ্রহ ছিল । যুদ্ধে এবং দ্রুত কুচ করিতে শত শত কষ্ট ও অভাব তিনি সাধারণ সৈন্যের মত অম্লানবদনে সহা করিতেন । র্তাহার হৃদয় ভয়ে দমিত হইত না, দুৰ্ব্বলতা বা দয়া তাহাকে গলাইতে পারিত না । প্রাচীন সাহিত্য চর্চা করিয়া তিনি সমস্ত হিতোপদেশ এবং রাজনীতিশাস্ত্র কণ্ঠস্থ করিয়াছিলেন । সিংহাসনে বসিবার পূৰ্ব্বে জীবনের অনেক বৎসর ধরিয়া দেশশাসন ও সৈন্যচালনে গভীর অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিলেন । অথচ এরূপ বিচক্ষণ সচ্চরিত্র এবং সজাগ সদা-শ্রমী রাজার পঞ্চাশ বৎসর রাজত্বের শেষ ফল কিনা তাহার রাজ্যের পতন এবং দেশময় গণ্ডগোল ! এই আশ্চৰ্য্য সমস্ত পূরণ করিতে হইলে আওরংজীবের রাজ্যকালের বিস্তৃত ইতিহাস চর্চা করা আবশ্যক। প্রাচীন গ্ৰীকসাহিত্যের ট্রাজেডী, অর্থাৎ বিয়োগান্ত নাটকগুলি জগতময় বিখ্যাত, তাহদের গঠন-প্রণালী যেমন নিপুণ, তাহাদের নৈতিক শিক্ষাও তেমনি উচ্চ । সেগুলি দর্শকের হৃদয় “সহানুভূতি ও ভয় সঞ্চার করিয়৷ পবিত্র করে ।” তাহীদের প্রতিপাদ্য বিষয়, ভাগ্যের বিরুদ্ধে মাহুষের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধশেষে কঠোর অদৃষ্টের হাতে আওরংজীবের জীবন এইরূপ ট্রাজেডীর একটি সম্পূর্ণ দৃষ্টান্ত ; মহাসাধু ও সজ্জন, বুদ্ধিমান