পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১ম সংখ্যা ] ജ്ഞാ সেদিন বোধ হয় পূর্ণিমা। সকাল থেকেই রোগিনীর অবস্থা খারাপ। ঠিক হ’ল যে, আমি আর নিৰ্ম্মল রাত্রি একটা অবধি জাগ ব তার পরে হিমানী ও মতিলাল বাকী রাতটুকু জাগবে। হিমানীর ঠাকুরমা রাত্রির পর রাত্রি পুত্রবধুর শিয়রে জেগে বসে থাকতেন, এতে তার কোনো ক্লাস্তি ছিল না। তবে তিনি ওষুধপত্র কিছু পাওয়াতে পারতেন না। পাছে ভুল ক’রে মালিশের ওষুধ পাইয়ে দেন এইজন্য আমাদের কারুকে থাকতেই হোতে । সে রাত্রি আমি আর নিৰ্ম্মল একটা অবধি জেগে মতিলালকে তুলে দিতে গিয়ে দেখি বিছানায় সে নেই। আমি আর নিৰ্ম্মল শুতুম ছাতের ওপরে একটা ছোট ঘরে । হাওয়া পাবার জন্য হয়ত সে আমাদের বিছানায় গিয়ে শুয়েছে মনে ক’রে ছাতে গিয়ে দেখি যে, এক কোণে মতিলাল ও হিমানী দাড়িয়ে আছে । হিমানী কাদছিল । তার মা যে আর বেশী দিন নেই এ কথা বোধ হয় সে বুঝতে পেরেছিল । দেগলুম সে ধাড় ঠোঁট ক’রে চোখে "াচল দিয়ে কাদছে আর মতিলাল গুন গুন ক’রে কি বলে তার মাথায় হাতে বলিয়ে দিচ্ছে । আমরা সিড়ির গোড়ায় এসে দাড়িয়েছি তা তাদের দু-জনের একজনও টের পায়নি । কিছুক্ষণ এইভাবে কাটবার পর হিমানী সেই অশ্রুসিক্ত আঁচলখানা গলায় জড়িয়ে ইঢ়ি গেড়ে মতিলালকে প্রণাম ক’রে উঠে দাড়াল, আর মতিলাল হিমানীর মুখখান তুলে ধরে তার অধরোষ্ঠে গভীর চুম্বনের দাগ একে দিলে। চাদের আলোতে মতিলালের মুখখান ঝকৃঝকৃ করছিল। তারই দেহের ছায়৷ হিমানীর মুখের ওপর পড়ায় তার মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। অবর্ণনীয় সেই আলো ও আবছায়ার খেলা। দক্ষালয়ে যাবার আগে সতী যখন মহাদেবের পায়ে মাথা ঠেকিয়েছিলেন, অভিমান-অপগত প্রিয়তমার প্রসন্ন মুখ দেখে ভোলানাথ বোধ হয় এমনিই বিহ্বল হয়েছিলেন। মৃত্যু যে সামনে এসে দাড়িয়েছে সংহারের দেবতা মহেশ্বর সেদিন নিজেই তা দেখতে পান-নি । হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে মতিলাল আমাদের দেখতে পেয়ে মতিলাল ১৩ হিমানীকে কি বললে। তার পরে আমাদের সঙ্গে কোনো কথা না বলেই তারা দুড় দুড় ক’রে সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল । পরদিন সকালবেলায় হিমানীর মা অচৈতন্য হ’য়ে পড়লেন । সমস্ত দিন তার আর জ্ঞান ফিরে এল না । সন্ধ্যাবেল আমি ও নিৰ্ম্মল একবার বাড়ী ঘুরে এসে তাদের বাড়ীতেই শুয়ে রইলুম। সেদিন আর কারুর ব্যস্ততা বা রাত-জাগবার পালা নেই। রোগিনী সকলকেই অবসর দিয়েছেন। সকলেই শেষ মূহূর্বের জন্য অপেক্ষা করছে । অনেক রাত্রে একবার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় রোগীর ঘরের জানলার ধারে গিয়ে দাড়ালম । ঘরের এক কোণে একটি বাতি জলছে । চারিদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম । সেই নিষ্ঠুর নিস্তব্ধতার মধ্যে রোগিনীর অন্তিম নিঃশ্বাস– জীবনগাথার শেষ রাগিণী তালে-তালে ধ্বনিয়ে উঠছে। জানলায় মুখ দিয়ে ভেতরে দেখলুম, মুমুধুর শিয়রে বসে আছেন হিমানীর বুদ্ধ পিতামহী আর তার দুপায়ের দু-পারে বসে হিমানী ও মতিলাল। সেই দৃশ্ব মনে পড়লে আজও আমার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। সেই দৃশ্ব দেখতে-দেখতে আমার মনে হোতে লাগল যেন রোগিনীর মাথার কাছে রুদ্র ভৈরব তার গৈরিক নিশান নিয়ে এসে দাড়িয়েছে, আর পায়ের কাছে মন্মথ তার মকরকেতন ওড়াচ্ছে । সংহার ও স্বষ্টির দুই দেবতায় মিলে উৎসব ক’রে সেই পুণ্যবতীকে মৃত্যুর পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আস্তে-অাস্তে সেখান থেকে সরে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লুম। পরদিন সকালে হিমানীর মা মারা গেলেন। দিনদুয়েক পরে তার বাবা এসে তাদের নিয়ে চলে গেলেন। সেবারে ছিল আমাদের প্রবেশিকা পরীক্ষা । দিন কয়েক বই নিয়ে বস গেল। পরীক্ষার পর মতিলালের কলকাতার বাসা তুলে দিয়ে তার বাবার কৰ্ম্মস্থলে চলে ༣༦ཀཱ་ག་ | মাসকয়েক মতিলালের আর কোনো খবর পাইনি । পরীক্ষায় পাশ করে আমরা কলেজে ঢুকলুম।