२२ বসে কবিতা লিখতে আরম্ভ ক’রে দিলে। মাসকয়েকের মধ্যে সে মোট-মোট খানকয়েক খাতা কবিতায় ভরিয়ে ফেললে। আমি সেগুলোকে মাসিকপত্রে ছাপাতে চাইলে সে বস্ত—লা না থাক, ওগুলো অন্য দরকারে লাগবে। শ্রাবণ মাস নাগাদ, অর্থাৎ হিমানী মারা যাবার মাস-ছয়েক পরে একদিন রক্ত বমি ক’রে মতিলাল বিছানায় এলিয়ে পড়ল। তার অবস্থা দেখে তক্ষুনি ডাক্তার ডাকা হ’ল। ডাক্তার দিনকয়েক দেখে বললেন—ওষুধে কিছু হবে না, বিদেশে নিয়ে গিয়ে দেখতে পারেন। আমাদের একটি বন্ধুর সাওতাল পরগণার এক স্বাস্থ্যকর জায়গায় ছোট একখানা বাড়ী ছিল । তাকে বলে-কয়ে মতিলালের জন্য বাড়ীখানা জোগাড় করা গেল । কিন্তু শুধু বাড়ী হলেই তো চলবে না, অর্থও কিছু চাই । মতিলাল বললে—আমার ঐ কবিতাগুলো যদি বিক্রি করতে পার তা হ’লে কিছু আসতে পারে। কবিতার খাত ক’খানা বগলে নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। কিন্তু কবিতার বই বিক্রি করতে এসেছি শুনে বইওয়ালারা তো হেসেই আকুল। সাতদিন প্রাণপণ চেষ্টা ক’রে একজন বইগুলো নিয়ে দয়া ক’রে একশটি টাকা দিলে। এ ব্যক্তি বইয়ের কারবার করার আগে সাহিত্যচর্চা কবৃত। মতিলালকে গিয়ে যখন সংবাদটা দিলুম, তখন সে বললে—কেমন বলেছিলুম কিনা, ওগুলো সময়ে ভারি কাজ দেবে। বললুম—আরও শতখানেক টাকা চাই যে— মতিলাল বললে—ঐতেই হবে—আর লাগবে না ! মতিলালকে নিয়ে যাওয়া গেল। সে স্থানটি জনবিরল। পুজো ও শীতের সময় দু-চার জন লোক আসে, অন্য সব সময়ে প্রায় সমস্ত বাড়ীতেই তালা লাগানো থাকে। সে সময়টা সেখানে বর্ষ নেমেছিল । বিকেলে রোজ এক পশলা বৃষ্টি হ’য়ে চমৎকার আলো হোতো। মতিলাল সেখানে দিনপাচেক বেশ রইল। ছ-দিনের দিন থেকে তার রক্তবমি কুরু হ’ল। দিনজুয়েক অনবরত বমি ক’রে সে একেবারে অবশ হ’য়ে পড়ল। প্রবাসী—বৈশাখ, ১৩৩৭ [ ৩০শ ভাগ, ১ম খণ্ড তারপরে দিন-ফুয়েক প্রায় নিৰ্ব্বাক অবস্থায় কাটিয়ে একদিন সকালে সে কথা বলতে আরম্ভ করলে। ইদানীং সে বেশী কথা বলতে না, কিন্তু সেদিন তার কথার পরিমাণ অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। আমি শঙ্কিত হয়ে উঠলুম, কারণ হিমানী যেদিন মারা যায় সেদিন সে-ও ঐ রকম কথা বলতে আরম্ভ করেছিল । বিকেলের দিকে সেদিন আর বৃষ্টি নামূল না। মতিলাল বললে—আমায় বারান্দায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিতে পার ? বাড়ীতে একটা মালী ছিল। তাকে ডেকে খাটসমেত মতিলালকে বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হ’ল। বাড়ীর কিছু দূরেই ছিল এক শালবন । তারই মাথায় প্রকাণ্ড একখণ্ড কাল মেঘ এসে দাড়াল, আর তারই মধ্যে বিজলীর ছিনিমিনি খেলা চলতে লাগল। মতিলাল আমার সঙ্গে কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে সেই দিকে চেয়ে রইল। সন্ধ্যার একটু পরেই মুষলধারে বৃষ্টি সুরু হ’ল। মতিলালকে ঘরের মধ্যে নিয়ে এসে দরজা জানলাগুলো বন্ধ করে দিলুম। দেখতে দেখতে প্রলয়ের নাচন সুরু হয়ে গেল। বাইরে আকাশ তার সম্পত্তি নিঃশেষ ক’রে দিতে চায়, আর ঘরের মধ্যে মতিলালের মহাপ্রাণ সেই জীর্ণ পিঞ্জর ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায়। ঘরে ও বাইরে সেই মহাপ্রলয়ের মধ্যে আমি এক হাপিয়ে উঠতে লাগলুম। রাত্রি তখন , প্রায় চায়টে । বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে, এমন সময় মতিলাল হৰ্ণপাতে-হাপাতে বললে— বেশ কাটানো গেল পৃথিবীতে—কি বল ভাই ? এবার অশ্রুসংবরণ করা দুরূহ হ’ল। বললুম— তোমার মতন দুঃখ— * মতিলাল আমার কথা থামিয়ে দিয়ে বললে—না না দুঃখ আমি কিছুই পাইনি রে—আমাকে দুঃখ দেবার চেষ্টা সংসার করেছে বটে, কিন্তু তাতে আমার সুখের মাত্রা বেড়েই উঠেছে— মতিলালের কণ্ঠস্বর মিলিয়ে এল। আমি খুকে পড়ে তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে যেতেই একটুখানি ।
পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।