পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রূপ ও রস শ্রীশৈলেন্দ্রকৃষ্ণ লাহা, এম-এ আমি সাহিত্যের রস এবং সাহিত্যের রূপের কথাই বলিতেছি। এ প্রবন্ধ সাহিত্যের আলোচনা, রূপ-রসের দার্শনিক ব্যাখ্যা নয় । আমরা সকলেই—ভাল হোক মন্দ হোক—অল্পাধিক পরিমাণে প্রতিমা গড়িতে পারি। প্রতিমার মধ্যে প্রাণের উদ্বোধন করিতে পারে কয়জন ? আকার দিবার ক্ষমতা মন্ত্রীপুত্রের ছিল। প্রাণসঞ্চারিণী বিষ্ঠ আয়ত্ত করিয়াছিল শুধু রাজপুত্র। কবি রাজপুত্র। কোটালের ছেলে হয়ত অস্থিসংস্থান করিলেও করিতে পারিত, প্রকৃত রূপ দিবার ক্ষমতা তাহার ছিল না। প্রতিমা গড়িবার, মূৰ্ত্তি নিৰ্ম্মাণ করিবার শক্তি— উচ্চতর শক্তি। মন্ত্রীপুত্র আর্টিষ্ট, রাজপুত্র কবি। মানুষ যদি ভগবানের স্বষ্টি হয় ত ভগবান একাধারে কবি ও কলাবিং মানুষও ভগবান। তাই মানুষ গড়িতে ও পারে এবং তাহার হষ্টিকে জীবন্তও করিতে পারে । মানুষের স্থষ্টি মানসিক । বাহিরের দিক দিয়া, ব্যবহারের দিক দিয়া প্রাণচঞ্চল ন হইলেও মথুরার বুদ্ধমূৰ্ত্তি তাহার প্রশান্তি স্থৈৰ্য্য করুণ ও নিলিপ্ততা লইয়া, অথবা অজস্তা প্রাচীরে অঙ্কিত অপারোযুগল তাহাদের উদ্যত গমনভঙ্গী এবং দেহের ললিত লীলা লইয়৷ মানুষের কল্পনাকুশল মনের কাছে চিরদিন সজীব । এই মূৰ্ত্তি-বিধায়িনী শক্তি আর্ট এবং মূৰ্ত্তিকে প্রাণময় মনোময় কামনাময় অতুভূতিময় করিবার শক্তি কবিত্ব । কবি নিজের জীবন দিয়া কাব্যের জীবন সঞ্চার করে, নিজের আনন্দ-বেদনায় কবিতাকে মানবী করিয়া তোলে। সকল কল রচনাই আর্ট ও কাৰ্যের সম্মিলন । কাব্য হোক, চিত্র হোক, সঙ্গীত হোক, যে-কোন কলাবস্তুকে দুইদিক দিয়া পরীক্ষা করা চলে। এক তার বাহিরের দিক-রূপ, আরেক তার অস্তরের দিক-রস । রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি, রস আমরা অনুভব করি। দেখিতে পাই বলিয়া রূপ বিচার-বিশ্লেষণের বস্তু, কিন্তু রস উপলব্ধির বিষয় । রূপ ও রসের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ। রূপের ভিতর দিয়াই আমরা রসের সন্ধান পাই। রসের আধার রূপ। প্রাণহীন দেহের মত রসহীন রূপের বরং কল্পনা করা চলে, কিন্তু রূপহীন রসের অস্তিত্ব নাই । রূপে ও রসে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা। রীতি, ভঙ্গী, বাক্য ও অর্থের গৌরব, বিষয়ের সংস্থান, রচনার সজ্জা—এ-সব হইল সাহিত্যের রূপ। যে রূপ দিতে পারে সে-ই আর্টিষ্ট । যেখানে শুধু বুদ্ধিমূলক বস্তু লইয়াই আলোচনা, ভয় বিস্ময় প্রেম কৌতুক ক্রোধ কামনার স্থান যেখানে নাই, সেখানে সুগঠিত হইলেও রচনা প্রকৃত সাহিত্য নয়। গঠন-কৌশল আমাদের মনের তৃপ্তি বিধান করে বলিয়া আমরা রচনাকে কখনো কখনো সাহিত্য পদবাচ্য করি। সেখানে শুধু আর্ট আমাদের মনকে মুগ্ধ করে। রচনা যেখানে সাহিত্য, সেখানে মানবহৃদয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত স্পষ্ট। সংশয়াত্মিক বুদ্ধি নয়, এই মানবহৃদয় রসের উৎস। কাব্য শুধু আর্ট নয়, কাব্য রসাত্মক । কবির সহমৰ্ম্মী হইয়া কাব্যে ও সাহিত্যে আমরা যে চিরনূতন আস্বাদ লাভ করি তাহাই রস। রস—কথা নয়, কল্পনা নয়, রীতি নয়, অর্থ নয়। রসকে পরিস্ফুট করিয়৷ তুলিতে হইলে এ-গুলির একান্ত প্রয়োজন বটে, এ সকলের মিলনজাত বস্তুও কিন্তু রস নয়। রস ভাবও নয়। ভাববস্তু যখন কবির হৃদয়াবেগে রূপান্তরিত হইয়া পাঠকের মনে আন্দোলন উপস্থিত করে তখন মাত্র তাহ রসে পরিণত হয় । কবি ও পাঠকের মনের সম্বন্ধের উপর রসের প্রগাঢ়ত নির্ভর করে। এ সম্বন্ধ অনির্দিষ্ট হইলে রসের উদ্বোধনও অস্পষ্ট হইয় ওঠে। তাই অরসিকে রসের নিবেদন ব্যর্থ হইয়া যায়।