পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৫৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মুসাফীর জসীম উদদীন চলে মুসাফার গাহি, এ জীবনে তার ব্যথা আছে শুধু ব্যথার দোসর নাহি। নয়ন ভরিয়া আছে অণখিজল, কেহ নাই মুছাবার, হৃদয় ভরিয়া কথার কাকলী, কেহ নাই শুনিবার । চলে মুসাফীর নির্জন পথে, দুপুরের উচ্চ বেল, মাথার উপরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া করিছে আগুন-পেলদুধারে উধাও বৈশাখ মাঠ, রৌদ্রেরে বুকে চাপি, ফাটলে ফাটলে চৌচির হয়ে করিতেছে দাপাদাপি । নাচে উলঙ্গ দমকা বাতাস, ধুলার বসন ছিড়ে, ফু দিয়ে ফু দিয়ে আগুন জালায় মাঠের ঢেলারে ঘিরে । দূর পানে চাহিঙ্গকে মুসাফীর, আয় আয় আয় আয়, কম্পন জাগে পর দুপুরের আগুনের হলকায় । তারি তালে তালে দুলে দুলে উঠে দুধারের স্তব্ধতা, হেলে নীলাকাশ দিগন্তে বেড়ি বাকা বনরেপ-লতা । চলে মুসাফীর দূর দূরাশীর জনহীন পথপাড়ি, বুকে করাঘাত হানিয়া সে যেন কি ব্যথা দেখাবে ফাড়ি । নামে দিগন্তে দুপুরের বেলা, অসে এলোকেশী রাতি, গলায় তাহার শত তারকার মুণ্ডমালার বাতি । মেঘের পাড়ায় রবিরে বধিয়া নাচে সে ভয়ঙ্করী, দূর পশ্চিমে নিহত দিনের ছিন্ন মুগু ধরি। রুধির লেখায় দিগন্ত ছায়, লোল সে রসনা মেলি, হাসে দিগন্তে মন্ত ডাকিনী করিয়া রক্ত-কেলি । চলেছে পথিক —চলেছে সে তার ভয়ঙ্করের পথে, বেদন তাহার সাথে সাথে চলে স্বরের ইন্দ্ররথে । ঘরে ঘরে জলে সন্ধ্যার দীপ, মন্দিরে বাজে শাখ, গায়ের ভগ্ন মসজিদে বসি ডাকে দুটে দাড়কাক । কবরে বসিয়া মাথা কুটে বাদে কার বিরহিণী মাত, চলেছে পথিক আপনার মনে বকিয়া বকিয়া যা-তা । চলেছে পথিক—চলেছে পথিক—কতদুর— কতদূর. আর কতদূরে গেলে পরে সে যে পাবে দেখা বন্ধুর । কেউ কি তাহার আশাপথ চাহি গণেছে বরষ মাস, ধুয়ার ছলায় কাদিয়া কি কেউ ভিজায়েছে বেশবাস কেউ কি তাহারে দেখায়েছে দীপ কোন গেয়ে ঘর হতে মাথার কেশেতে পাঠায়েছে লেখা গংকিনী নদীসেণতে ? চলেছে পথিক চলেছে সে তার ললাটের লেখা পড়ি, সীমালেখাহীন পথ-মায়াবীর অঞ্চলখানি ধরি ; ঘরে ঘরে ওঠে মৃদু কোলাহল, বধুর বধুর গলে, বাহুর লতায় বাহুরে বাধিয়া প্রণয়-দোলায় দোলে । বাশী বাজে দূরে মুখরজনীর মদির স্ববাস ঢালি, দীঘির মুকুরে হেরে মুখ রাত চাদের প্রদীপ জালি । নতুন বধর বক্ষ জড়ায়ে কচি শিশু বাহু তুলি, হাসিয়া হাসিয়া ছড়াইছে যেন মণি-মাণিকের ধূলি । চলিছে পথিক—রহিয়া রহিয়া করিছে আৰ্ত্তনাদ, ও যেন ধরার সকল মুথের জীবন্ত প্রতিবাদ । রে পথিক, বল, কারে তুই চাস, যে তোরে এমন করে, কাদাইল হায়, কেমন করিয়া রহিল সে আজ ঘরে ? কোন ছায়াপথ নীহারিকাপারে, দেখেছিলি তুই কারে, কোন সে কথার মাণিক পাইয়া বিকাইলি আপনারে । কার গেহ ছায়ে শুনেছিলি তুই চুড়ির রিনিকি ঝিনি, কে তোর ঘাটতে এসেছিল ঘট বুড়াইতে একাকিনী ! চলে মুসাফীর আপনার রাহে কোন দিকে নাহি চায়, দূর বনপথে থাকিয়া থাকিয়া রাত-জাগা পার্থী গায় । গগনের পথে চাদেরে বেড়িয়া ডাকে পিউ, পিউ কাহা, সে মৌন চাদ আজো হাসিতেছে, বলিল না, উহু আহা । বউ কথা ক ও—বউ কথা কও – কতকাল– কতকাল, রে উদাস, বল, আর কতকাল পাতিবি স্বরের জাল ! সে নিষ্ঠুর আজো কহিল ন কথা, রহস্য-যবনিক, খুলিয়৷ আজিও পরালু না কারে ললাটে প্রণয়-টাকা । চলেছে পথিক চলেছে সে তার দূর দুরাশার পারে, কোনো পথ বাকে পিছু ডাকে আজ ফিরাল না কেউ তারে চলেছে পথিক চলেছে সে যেন মৃত্যুর মত ধীরে, যেন জীবন্ত হাহাকার আজি কাদিছে তাহারে ঘিরে!