পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৬৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হুগলীর পল্লীকবি রসিক রায় শ্রীমনোমোহন নরসুন্দর দেশবন্ধু একবার আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছিলেন—“বাংলার খাটি লোক-সাহিত্য ও গ্রাম্য-সাহিত্য দিন দিন লুপ্ত হ’তে চলেছে । এদিকে কারও লক্ষ্য নাই ।” কবিওয়ালারা চলতি কথার ভিতর দিয়া জীবনের যে আদর্শ গাহিয়৷ যাইত সহজ কথায় সাধারণের বোধগম্য ভাষায়— পুরাণের, ভাগবতের, গীতার, রামায়ণের, মহাভারতের বিশেষ বিশেষ চরিত্রের দোষগুণ বিচার করিয়া সাধারণের কাছে যে আদর্শ প্রচার করিত, সে প্রচারের কাল আর নাই । যাত্রাওয়ালার দল এখনও কোনো রকমে টিকিয়া আছে। একশত বৎসর আগেকার কথা—বাংলার রঙ্গমঞ্চে দৃশ্যপট-সংযোগে নাটকীয় অভিনয় সুরু হয় নাই। কবিওয়ালার তর্জা এবং যাত্রাওয়ালার যাত্রা-গানে তখন বাংলার পল্লী মুখরিত হইয়া উঠিত। সহরেই যাত্রা গান ও কথকতার প্রাধান্ত ছিল বেশী। উভয় দলের তর্ক কবিওয়ালাদিগের গানের এক প্রধান অঙ্গ, আবার মস্ত বড় কলঙ্কের মূলও ছিল বটে। যে দল তর্কে জিতিত সেই দলেরই খাতির বেশী হইত। এই খাতিরের উপরই পয়স-উপায়ের ভিত্তি স্থাপিত ছিল। তাই বিধিমত শাস্ত্রের বিচার অনেক সময়ে মাঠে মারা যাইত । অশিক্ষিত শ্রোতার মনোরঞ্জনের জন্য ইহাদিগকে বাধ্য হইয় অন্যায় কুতর্কের আশ্রয় লইতে হইত। এই তর্কের হাত এড়াইয় নিৰ্ম্মলভাবে লোকশিক্ষা দিবার ইচ্ছায় দাশুরায়ের মনে এক নুতন প্রেরণা জাগিল । সেই প্রেরণার ফলেই বাংলা-সাহিত্যে পাচালীর আমদানী । সরলপ্রাণ পল্লীকৃষকের মনে তখন কবির দলের গানের মস্ত বড় মোহ। সেই মোহু কাটাইয়। পাচালীকে জয়লাভ করিতে হইবে । ব্যাপারটি বড় সহজ ছিল না। কবিওয়ালারা যে কেমন করিয়া জনসাধারণের মনের উপর এতটা আধিপত্য করিয়া বসিল তাহার ঐতিহাসিক আলোচনা করিলে মনে হয়, রায় গুণাকরের অন্নদামঙ্গল ও বিদ্যাস্বন্দর রাজসভায় গীত হইবার পর যখন ভারতের প্রভূ-পরিবর্তনে সাহিত্যের আসর রাজ-সভায় বসিবার স্থযোগ হারাইল, তখন একদল লোক ভাঙিয়া-চুরিয়া এক নূতন তথ্যের সন্ধান লইয়া রাজ-সভা হইতে বঞ্চিত হইয়া পৌরসভায় আসর জুড়িয়া বসিল । কবির সঙ্গীত সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন— “কবির দলের গান আমাদের, সাহিত্যু এবং সমাজের একটি অঙ্গ, এবং ইংরেজের অভু্যদয়ে যে আধুনিক সাহিত্য রাজসভা ত্যাগ করিয়া পৌরজনসভায় আতিথ্য গ্রহণ করিয়াছে, এই গানগুলি তাহারই প্রথম পথপ্রদর্শক ।” সাধারণের বাঁহবা পাইবার জন্য বাধ্য হইয়া কবিওয়ালাদিগকে সাহিত্যরসকে বিকৃত করিয়া উত্তেজনার স্তষ্টি ও অনুপ্রাসের ঘটা—এই উভয়েরই আশ্রয় লইতে হইয়াছিল। * বাংলা-সাহিত্যে দাশরথি রায়কে প্রথম পাচালীকার বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। তরুণ কবিওয়াল দাশরথি যেদিন কবির আসর ছাড়িয়া পাঁচালীর আসর সরগরম করিয়া তুলিলেন, সেইদিন লোকশিক্ষার প্রভাব অন্যভাবে নিয়ন্ত্রিত হইল। কিন্তু লোকের বাহব। অর্জন করিতে না পারিলে এই প্রকারের সাহিত্যিকের নাম হয় না। তার উপর পাচালী ত নুতন জিনিষ । এর জন্যই পাচালীকারকেও ঐ একই প্রকার উত্তেজনা ও অনুপ্রাসের আশ্রয় লইতে হইল । তাহার ফলে পাচালীর মধ্যে (১) ছড়া ও (২) গানের স্বষ্টি । পাচালীই বাংলার জনসাধারণের খাটি সাহিত্য। পথের কথা, নীতির কথা, পুরাণের কথা লইয়াই এগুলি রচিত। তাই কবিওয়ালাদিগের যুগে পাচালীকার