পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৭৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫ম সংখ্যা ] এই দুই প্রকারের লোককে গীতা স্পষ্টই শুনাইয়া দিয়াছে যে, “কৰ্ম্ম বিনা কেহই সিদ্ধিলাভ করে নাই ; জনকাদিও কৰ্ম্ম দ্বারা জ্ঞানী হইয়াছিলেন। যদি আমিও আলস্তরহিত হইয়া কৰ্ম্ম না করি তাহা হইলে এই লোক ংস হইবে।” একথার পরও সাধারণ লোকের সম্বন্ধে আর কি বলার আছে ? কিন্তু একভাবে কৰ্ম্মমাত্রই বন্ধনস্বরূপ একথা অবিসস্বাদী। অপরদিকে দেহধারীমাত্রকেই ইচ্চায় হউক, অনিচ্ছায় হউক কৰ্ম্ম করিতে হয়, শারীরিক ও মানসিক চেষ্টামাত্রই কৰ্ম্ম । তাহ হইলে কৰ্ম্মনিরত মাস্থ্য কেমন করিয়া বন্ধনমুক্ত হইতে পারে? আমি যতদূর জানি, গীতায় এ প্রশ্নের যেরূপ সমাধান করা হইয়াছে, অন্য কোন ধৰ্ম্মগ্রন্থেই সেরূপ করা হয় নাই । গীতায় বলা হইয়াছে—“ফলাসক্তি ছাড় এবং কৰ্ম্ম কর, নিরাশী হও এবং কৰ্ম্ম কর। নিষ্কাম হইয়া এই কৰ্ম্ম কর।” গীতার এই উক্তি ভুল বুঝিবার উপায় নাই । কৰ্ম্ম যে ছাড়িল তাহার পতন হইল ; কৰ্ম্ম করিতে করিতেই ফল ত্যাগ করিলে ত উন্নতি হইল । এস্থলে ফলত্যাগের এই অর্থ কেহই করে না যে, ত্যাগী কোন ফল পান না । গীতার কোথাও এই অর্থ নাই । ফলত্যাগের অর্থ ফলের বিষয়ে আসক্তি ত্যাগ । প্রকৃতপক্ষে ফলত্যাগী হাজার গুণ ফল লাভ করেন । গীতার ফলত্যাগে অক্ষুন্ন শ্রদ্ধার পরীক্ষা রহিয়াছে। যে লোক পরিণাম চিস্ত করে, সে বহুবার কৰ্ম্ম অর্থাৎ কৰ্ত্তব্য হইতে ভ্ৰষ্ট হয় । সে অধীর হইয় উঠে, তাহাতে সে ক্রোধের বশীভূত হয়, তখন সে যাহা করা উচিত নহে তাহাই করে, এবং এক কৰ্ম্ম হইতে দ্বিতীয়ে এবং দ্বিতীয় হইতে তৃতীয়ে জড়িত হইয় পড়ে। পরিণামচিন্তাকারীর অবস্থা বিষয়ান্ধের মতই হয় এবং শেষে সে-ও বিষয়ীর মত সারাসার নীতি-অনীতির বিচার ত্যাগ করিয়া ফললাভের-জন্ত যে-কোন উপায় অবলম্বন করে এবং তাহাকেই ধৰ্ম্ম বলিয়া গণ্য করে। ফলাসক্তির এইরূপ কটু পরিণাম হইতে মুক্তির উপায়স্বরূপ, গীতাকার অনাসক্তি অর্থাৎ কৰ্ম্মফলত্যাগের সিদ্ধাস্ত আবিষ্কার করিয়াছেন এবং অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক অনাসক্তিযোগ . Ꮼbr© ' ভাষায় তাহ জগ}তর সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছেন । সাধারণ বুদ্ধিতে kনে হয়, ধৰ্ম্ম ও অর্থ পরস্পর বিরোধী, “ব্যবসায় প্রভৃতি লৌকিক ব্যাপারে ধর্মের স্থানও নাই, ধৰ্ম্ম রক্ষাও হয় না, ধৰ্ম্মের প্রয়োজনীয়তা মোক্ষেরই জন্য হইতে পারে। ধৰ্ম্মের ক্ষেত্রে ধৰ্ম্ম শোভা পায়, অর্থের ক্ষেত্রে অর্থ।” আমার মতে গীতাকার এই ভুল ধারণার নিরাকরণ করিয়াছেন। তিনি মোক্ষ এবং লৌকিক ব্যবহারের মধ্যে কোন ভেদ রাখেন নাই এবং ব্যবহারের মধ্যেই ধৰ্ম্মের সার্থকত প্রতিপন্ন করিয়াছেন । আমার মনে হয়, গীতায় বলা হইয়াছে যে, যে-ধৰ্ম্ম কৰ্ম্মের মধ্যে অভ্যাস না করা যায়, তাহ ধৰ্ম্মই নয় অর্থাৎ গীতার মতে যে-সকল কৰ্ম্ম আসক্তি-বিনা করাই যায় না, তাহ পরিত্যজ্য । এই সুবর্ণ নিয়ম মানুষকে বহু ধৰ্ম্মসঙ্কট হইতে বাচাইতেছে। এই মত দ্বারা হত্য, ব্যভিচার, মিথ্যাচার প্রভৃতি সহজেই ত্যাজ্য হইয় পড়ে। মানুষের জীবন সরল হয় এবং সরলতা হইতেই শাস্তি উৎপন্ন হয়। পরিণাম সম্বন্ধে বেপরোয়া ভাবও ফলত্যাগের অর্থ নয়। পরিণাম, উপায়-বিচার এবং তাহার সম্বন্ধে জ্ঞান অত্যন্ত প্রয়োজন। এগুলা হইলে যে লোক পরিণামের ইচ্ছা না করিয়াই সাধনের মধ্যে তন্ময় হইয়া যাইতে পারে সে-ই ফলত্যাগী । এইরূপ দৃষ্টি দ্বারা বিচার করিতে করিতে আমার এরূপ বিশ্বাস হইয়াছিল যে, গীতার শিক্ষা যে কাৰ্য্যে পরিণত কবিতে চাহে তাহাকে স্বভাবতই সত্য এবং অহিংসা পালন করিতে হয়। ফলাসক্তি না থাকিলে মানুষের পক্ষে অসত্য বলিবার বা হিংসা করিবার লোভ হয় না। হিংসা বা অসত্যমূলক যে-কোন কাৰ্য্যই বিচার করা হউক না কেন, দেখা যাইবে যে, তাহার পিছনে নিশ্চয়ই ফলাকাঙ্ক্ষা আছে। কিন্তু অহিংসার প্রতিপাদন করাই গীতার উদ্দেশ্য নহে। গীতার যুগের পূৰ্ব্বেও অহিংসা পরমধৰ্ম্মরূপে গণ্য হইত। গীতার উদ্দেশ্য ছিল অনাসক্তিরূপ সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা । দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই কথা স্পষ্টই দেখা যায়। কিন্তু যদি অহিংসাই গীতার সিদ্ধাস্ত হয়, কিংবা অনাসক্তির মধ্যে অহিংসা সহজেই আসে, তাহা হইলে