সুন্দর নয়, তাহার মধ্যে সৌন্দর্য্যকে অনুভব করিবার উপাদান আছে। কিন্তু তাই বলিয়া এই রচনাটি না শুনিলে, এই ছবিখানি না দেখিলে, বাহির হইতে কোনো স্পর্শ না আসিলেও যে অন্তরে যাহ আছে তাহাকে আমরা অনুভব করিতে পারিব, তাহা নয়। চিত্তে যে বীণাটি রহিয়াছে বাহির হইতে স্পর্শ লাগিলে তবেই সে ঝঙ্কৃত হইয়া উঠিবে। কাজেই প্রাকৃতিক যে-সমস্ত দৃশু, যেসমস্ত বস্তু আমাদের নিকট সুন্দর বলিয়। মনে হয়, তাহ তখনি মনে হয় যখন সে আমাদের ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়া অন্তরে যে সৌন্দর্য্যবোধটি আছে তাহার সহিত মিলিত হয় । একটি স্বর বাজিয়া উঠিলে প্রথম যখন তাহ কর্ণের তারে তারে ধ্বনিত হইতে থাকে তখনও তাহার সৌন্দৰ্য্যকে বা মধুরতাকে আমরা উপলব্ধি করিতে পারি না । কর্ণ তাহাকে গ্রহণ করিলে পর, কর্ণ হইতে সে যখন অস্তরে প্রবেশ করে, সেখানে সৌন্দর্য্য অনুভব করিবার যে বৃত্তিটি আছে সে যখন তাহাকে গ্রহণ করে, স্বীকার করে, তখনই তাহার সমস্ত সৌন্দর্য্য আমাদের নিকট প্রতিভাত হয় । তাই বাহিরে এই যে পদার্থটি রহিয়াছে এইটি সুন্দর হইয়া নাই, তবে এ যখন আমাদের বাহ্য ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির মধ্য দিয়া অস্তরের অনুভূতিটির সহিত একটি বিশেষভাবে মিলিত হয় এবং সে যখন ইহাকে স্বীকার করিয়া লয় তখনি ইহা সুন্দর হইয় উঠে। কিন্তু অস্তরের সেই যে বৃত্তিটি, সেই যে সৌন্দৰ্য্য অনুভব করিবার শক্তিটি রহিয়াছে, সে কাহাকে গ্রহণ করিবে কাহাকে ফিরাইবে, কাহাকে স্বীকার করিবে , কাহাকে অস্বীকার করিবে, তাহা বুঝিবার বা জানিবার কোনও উপায় নাই। সে কেন নিল কেন ফিরাইল, কেন বলিল এইটি স্বন্দর এইটি অম্বন্দর, তাহ জানিতে পারা যায় না, সেইজন্তই কখনই এমন কোনও কিছু স্থির করিয়া বলা সম্ভব নয় যে এইটি এমন করিলে সুন্দর হইবে বা সৌন্দর্য্য স্বষ্টি করিবার এই নিয়ম । যাহা হুষ্টি করিতেছি, যাহা দেখিতেছি, অস্তরের সেই বোধশক্তিটি সমস্ত বুঝিয়া . দেখিতেছে, সে যাহাকে গ্রহণ করিতেছে আমরা তাহাকে স্বন্দর বলিয়া অনুভব করিতেছি ; কিন্তু কি করিলে সে গ্রহণ করিবে তাহ পূৰ্ব্বে জানিতে পারি না। তবে হয়ত ৬৭ অনেক সময় বহুবার দেখিবার পর যখন সেই চিত্তবৃত্তির রুচির সহিত আমাদের পরিচয় ঘটে, তখন কিয়ং পরিমাণে অনুভব করিতে পারি। যেমন আমরা অনেক সময় মনে করি যে,ঐক্যের একটি সৌন্দৰ্য্য আছে ; সে যে কোনও অন্তরের নিয়মের প্রত্যক্ষ সন্ধানের দ্বারা মনে করি, তাহ নয়। অনেকবার সেইরূপ ঘটিয়াছে বলিয়া অকুমান করিয়া লই যে, সামঞ্জস্য সৌন্দৰ্য্য-হৃষ্টির একটি নিয়ম, ইংরাজিতে যাহাকে generalize করা বলে । কিন্তু অনেক স্থলে এইটি কি করিলে সুন্দর লাগিবে বা কেন সুন্দর লাগিতেছে এইরূপ অনুমান করাও সম্ভব হয় না। শুধু মাত্র একটা অব্যক্ত বোধে বুঝিতে থাকি এইটি সুন্দর,এইটি সুন্দর নয়। তাহা হইলে এখানে এই কথাটি বলা হইল যে, বাহিরের দৃগু, গন্ধ, স্বর প্রভৃতি সৌন্দয্যের উপকরণ যখন ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ধ্বনিত হইয় অস্তরের সেই বৃত্তিটির সহিত মিলিত হয় তখনি তাহ সুন্দর হয়, তখনি আমরা সৌন্দর্য্যকে অনুভব করি । সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে এই ত গেল সাধারণ কথা ; এখন তাহা হইলে এ কথা মনে হইতে পারে যে, সাহিত্য বা শিল্পের ( অর্থাং যাহাকে ইংরাজিতে artistic creation বলে ) সৌন্দর্য্য তবে কি ? প্রকৃতি বা অন্য কোনো বিষয় সম্বন্ধে একথা চলিতে পারে, কিন্তু সাহিত্য ত বাহিরের কিছু নয়। কিন্তু সাহিত্য বা শিল্প অন্তরের স্বষ্টি হইলেও ইহার সমস্ত উপাদান ত বাহিরেই রহিয়াছে, কারণ প্রতিদিন আমরা যাহা দেখিতেছি, যাহা শুনিতেছি, যাহা পাইতেছি, যাহা হারাইতেছি সমস্ত জড়াইয়া মনের মধ্যে যে ছাপটি রহিয়া যায়, এই পৃথিবীর সহিত প্রতিদিনের ব্যবহারে যে জ্ঞান লাভ করি, যে রূপ আহরণ করি শিল্প বা সাহিত্য-স্থষ্টির সেই ত প্রধান উপকরণ । সেই প্রতিদিনের চাওয়া-পাওয়া-দেখা-শোনা জ্ঞানকেই ত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ধারণ করিয়া চিন্তাধারার সহিত গাথিয়৷ অন্তরের সেই বৃত্তিটির নিকট উপস্থিত করি। কাজেই বাহিরের সহিত সম্পর্ক রহিত কোনও কিছু সাহিত্য বা শিল্পের বিষয় হইতে পারে না । বাহির হইতে যাহা পাই, শরীরে যাহা অনুভব করি তাহাকেই চিস্ত দ্বারা, বুদ্ধির দ্বারা সাজাইয়া ছন্দে, সুরে, রঙে একটি নূতন রূপ দান করি, এবং সেই রূপটিই যখন আভ্যন্তরীণ
পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৮৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।