পাতা:প্রবাসী (ত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১ম সংখ্যা ] বন্দী ዓ » দোকানদারের সঙ্গে পাহারাওয়ালাকে দেখিয়া সে কিছুই বুঝিতে পারিল না। পাহারাওয়ালা নোট কয়খানা দেখাইয়া কালীচরণকে জিজ্ঞাসা করিল,—এ নোট তুমি কোথায় পাইলে ? কালীচরণ বিস্মিত হইয় কহিল,—আমি নোট কোথায় পাব ? এ নোট বাবুর। —বাবু কোথায় ? —বাবু একজনের সঙ্গে দেখা করে হয়ত ফিরে আসচে। মোড়ের গোড়ায় দাড়িয়ে থাকতে পারে। পাহারাওয়াল, দোকানদার, কালীচরণ বাহিরে আসিয়া চারিদিকে অনেক খুজিল, বাবুর কোথাও দেখা পাওয়া গেল না। পাহারাওয়াল কালীচরণকে গলাধাক্কা দিয়া, গালি দিয়া থানীয় লইয়া গেল । দোকানদার থানায় গিয়া লিথাইল, কালীচরণ দোকানে এক আসিয়াছিল, তাহার সঙ্গে কোন বাবু ছিল না । পুলিশের লোক কালীচরণকে সঙ্গে করিয়া যখন বাবুদের বাসায় গেল তখন বাস খালি, পার্থী উড়িয়া গিয়াছে। ঘরগুলায় চারিদিকে তচনচ হইয়া আছে, যাহারা ছিল তাহদের বড় তাড়া, বগীর ভয়ে যেমন ঘর-জুয়ার ছাড়িয়া লোকে পলায়ন করিত সেই রকম পলায়ন করিয়াছে। দেখিয়া শুনিয়া ইন্সপেকূটর বলিল,—এর সঙ্গে আরও লোক আছে, তারা সব ফেরার । অনুসন্ধানে কালীচরণের যথার্থ পরিচয় পাইতে বিলম্ব হইল না। সে যেমন জানিত তাহাই বলিল, কিন্তু সে কতটুকু ? সাক্ষীর বেল বিশ পচিশ জন দোকানদার, মুদি, পসারী তাহাকে সনাক্ত করিল। সকলেই একবাক্যে বলিল, এ ব্যক্তি নোট ছাড়া কখন টাকা আনিত না, সব নতুন নোট, আর পরে জানা গেল সব জাল। ইন্সপেক্টর কালীচরণকে জুতার ঠোক্কর মারিয়া বলিল,—শালা, ঝান্ত, বোকা সেজেচে । দায়রার বিচারে কালীচরণের সাত বৎসর মেয়াদ . হইল । সেই যে পুলিশ কালীচরণকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল সেই হইতে সে যেন কি রকম হইয়া গেল। থানায়, আদালতে, জেলে হাবা কালা জন্তুর মত হইয়া থাকিত, মুখে বড় একটা কথা নাই, চক্ষে শূন্তদৃষ্টি, কলের মত চলা-ফেরা করে, কলের মত খাটে । কাজে সে চটপটে কোনকালেই ছিল না, এখন যেন আরও অকৰ্ম্মণ্য হইয়া পড়িল । অন্য কয়েদী যে কাজ দু ঘণ্টায় করে সে কাজ তাহার করিতে চার ঘণ্টা লাগে। দুই একবার জেলর তাহাকে শাস্তি দিল, কিন্তু বেত মারিতে ডাক্তার নিষেধ করিল, কারণ দেশের মেলেরিয়ায় তাহার শরীর খারাপ হইয়া গিয়াছিল। জেলর লক্ষ্য করিয়া দেখিল, ৩৫১ নম্বর কয়েদী কাজে ফাকি দেয় না, অলসও নয়, কিছু নিড়বিড়ে, কাজ করিতে সময় অধিক লাগে । কাজ না থাকিলে কালীচরণ চারিদিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিত । চারিদিকে সেই চারিট প্রাচীর, মাথার উপর সেই থানিকট আকাশ। শব্দের মধ্যে কয়েদীদের পায়ের বেড়ীর শব্দ, জাতার ঘরঘরাণি, ওয়ার্ডারের ধমক, কয়েদীদের হাসি আর গল্প। এই প্রাচীর-বেষ্টিত সঙ্কীর্ণ স্থানের বাহিরে আর কিছু আছে কি ? বাহিরে কি লোকালয়, গ্রাম আছে, তাহার পাশে ধান ভর ক্ষেত ? পুকুরের পাড়ে কি মেয়ের বাসন মাজে ? মাঞ্জিবার সময় পিতলের চুড়ীতে কি ঠন্‌ ঠন্‌ করিয়া শব্দ হয় ? মাঠে কি ছেলেরা হাড় ডু ডু খেল করে, বাশ গাছে বসিয়া কি ঘুঘু ডাকে ? সন্ধ্যায় সময় সেই যে কে গান গাহিতে গাহিতে চলিয়৷ ঘাইত সে কি এখনও তেমনি গান করে ? এই সব ভাসা ভাসা দিবাস্বপ্নের মধ্যে আর একটা স্বপ্ন যেন তাহার বুক চাপিয়া ধরিত। তাহার মেয়ে হিমী তাহার বড় নেওট, সে কি বাপকে খোজ করে না ? তাহার স্ত্রীর কেমন করিয়া চলে ? ভাবিতে ভাবিতে তাহার দৃষ্টি আরও শূন্ত হইয়া যায়, স্বর্ঘ্যের আলোক যেন তাহার চক্ষের সম্মুখে নিভিয়া যায়। আর একজন কয়েদী তাহার পাশে আসিয়া, তাহাকে আঙুলের খোচা দিয়া বলিল,—কি রে, কি ভাবচিস্ ? কালীচরণের একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়িল, বলিল,—কি আর ভাবব ? —এই দেশের কথা ? —তাই ভাব চি ।