পাতা:প্রবাসী (দশম ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

-Sb প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও শরীরবিজ্ঞান সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ উপদেশ দিবার চেষ্ট হইতেছে ; ইহা উত্তম কথা । আধুনিক নিম্নশিক্ষার প্রণালী এইরূপে নানা শাস্ত্রে কিঞ্চিৎ জ্ঞানদানের চেষ্টা করে ; পরস্তু তার চেয়েও একটু অধিক কাজ করিতে চায়। উপযুক্ত ব্যবস্থার দ্বারা দেশের বালকবালিকাকে কিছু না কিছু জ্ঞান দেওয়া যাইতে পারে ; কিন্তু লোকাভাব, ধনাভাব, সময়াভাব, প্রভৃতি নানা অভাবে এইরূপে উপদিষ্ট জ্ঞানের মাত্রা বড় অধিক হয় না। এমনকি, বালকের যে বিদ্যাটুকু উপার্জন করে, ব্যবহার কালে তাহা প্রয়োগ করিতে পারে না। তাই আজকাল বুদ্ধিমান লোকে বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন, যে জ্ঞানদানের চেষ্টা অপেক্ষা জ্ঞানাহরণে ক্ষমতা সঞ্চারের চেষ্টা করিলে उांश श्ध्न । -- ফলে চাষার ছেলে,—সম্ভবতঃ ভবিষ্যতে যে রাজমন্ত্রী হইবার কোনও অবসর পাইবেন না, বা যে কালিদাসের মত কবি বা নিউটনের মত বৈজ্ঞানিক হইবার সুযোগ পাইবে না—যাহাকে লাঙ্গল ধরিয়া জমি হইতে ফশল তুলিতে হইবে,—তাহাকে দশটা হইতে পাচটা পৰ্য্যস্ত ইস্কুলে পুরিয়া সমগুণশ্রেট ও সন্থ সমুখান, যবক্ষার জান ও ক্লোমরস, ইব্রাহিম লোদি ও জুলপ ফাৰ্ণাণ্ডেজের বিবরণ মুখস্থ করাইবার অদ্ভূত চেষ্টা সম্পূর্ণ নিরর্থক ও ভয়াবহ। ইহাতে তাহার কোন লাভ হয় না ; প্রত্যুত ক্লোমরসের আলোচনায় পিত্তরসে বিকার জন্মে, এবং সস্তৃয় সমুখান ও ইব্রাহিম লোদির বিভীষিকাজাত দুঃস্বপ্নে অনিদ্রা রোগ উপস্থিত হয়। শিক্ষার্থ বালকের জ্ঞান বৃদ্ধি ও শক্তি বৃদ্ধির পরিবর্বে এইরূপ শিক্ষার প্রণালী তাহার নৈসর্গিক শক্তিকে সঙ্কুচিত করে, ও জীবনের পথে দক্ষতার পরিবর্তে শোচনীয় অক্ষমতা আনিয়া দেয়। যদি কোন কৃষকসস্তানে বিস্মার্কের বা কালিদাসের বা নিউটনের অক্ষুর গজাইবার সম্ভাবনা থাকে, সেই অঙ্কুরকে টিপিয়া মারিবার এমন উৎকৃষ্ট উপায় মীর নাই। এইরূপ শিক্ষার বিস্তার অপেক্ষা ইহার কবল হইতে শিক্ষার্থীকে রক্ষা করাই সামাজিকের পক্ষে কর্তব্য বলিয়া মনে করি । প্রকৃতি ঠাকুরাণী, যিনি মানবশিশুকে নিতান্ত অসহায় অবস্থায় সংসারের রণক্ষেত্রে প্রেরণ করিয়াছেন, মানবসমাজ প্রবাসী—বৈশাখ, ১৩১৭ । [ ১০ম ভাগ । সেই শিশুর শক্তিবৃদ্ধি ও সামর্থ্য লাভ পক্ষে কতটা ব্যবস্থা করিবে না করিবে, সে বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকেন নাই। এ বিষয়ে মানবশিশুর প্রতি তাহার মমত্বের পরিচয় নানা রূপে পাওয়া যায়। মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হইয়াই বাহ্যজগতের সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয়লাভে স্বভাবের প্রেরণাতেই প্রবৃত্ত হয় ; এবং প্রকাও বৈজ্ঞানিকের মত পৰ্য্যবেক্ষণ ও পরীক্ষ zotog—observation 3 কার্য্যে— প্রবৃত্ত হয়। দিবানিশি সে ইচ্ছাপূৰ্ব্বক ও আনন্দের সহিত এই কৰ্ম্মে ব্যাপৃত থাকে ; ইহার জন্য প্রলোভন বা শাসন কিছুমাত্র আবখ্যক হয় না। মাষ্টারের বেতেরও দরকার হয় না ; রাঙা ফিতায় বাধা প্রাইজের বহিও দিতে হয় না। তাহার এই জ্ঞানতৃষ্ণার নিকট অতি বড় পণ্ডিতেও হারি মানেন ; লর্ড কেলবিনকেও জ্ঞানসংগ্রহপ্রবৃত্তিতে এই শিশু বৈজ্ঞানিকের নিকট হারি মানিতে হয়। যাহা আমরা সৰ্ব্বদা চোখের উপর দেখিয়া অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি, তাহার গুরুত্ব উপলব্ধি করিতে পারি না। আমাদের এই বাঙ্গল দেশে চাষার ছেলে অষ্টম বর্ষে উপনীত হইয়াই যে গুরুর নিকট বিদ্যালাভে প্রেরিত হয়, তাহার মত সদগুরু জগতে নাই। নিসর্গ দেবতা স্বয়ং গুরুগিরিতে প্রবৃত্ত রহিয়াছেন। রাতি পোহানর সঙ্গে যখন পার্থী সব কলরব করিয়া উঠে, ও কাননে কুমুম কলি ফুটিয় উঠে, বাঙ্গালার প্রত্যেক পল্লীর ঘরে ঘরে তখন বালগোপাল রাখালবেশে সাজিয়া গরুর পাল সঙ্গে মাঠে বাহির হইয়া থাকে, এবং এই গোপাললীলার অবসরে সে যাহা অর্জন করে, তাহার সহিত, সদাশয় বাঙ্গালা গবর্মেন্টের experiment স্থাপিত কিণ্ডারগার্টেন প্রণালী মার্জিত গুরু মহাশয়ের । পরিচালিত কোন প্রাইমারি স্কুলে টেকৃষ্টবুক কমিটির অযু- | মোদিত গ্ৰন্থরাশির গলাধঃকরণে যে বিদ্যা অর্জিত হয়, তাহার তুলনা চলে না। খোলা মাঠের মুক্ত হাওয়ার মধ্যে দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি, গাছের ডালে বসিয়া ঝুলনবাজি, এ ডাল হইতে ও ডালে লাফ, নদী-নালার এ পার হইতে ও পারে সাতার, ক্রীড়াকৌতুক মারামারি হাস্যকলরব, স্মরণে আনিয়া এই বৃদ্ধ লেখকেরও হৃৎপিণ্ডে স্পন্দন উপস্থিত হইতেছে। ইহাতে জড় জগতের সহিত যেরূপ অন্তরঙ্গ পরিচয়লাভ ঘটে, কোন বোধোদয় বা বিজ্ঞানপাঠের সাহায্যে তাহা ঘটিবার ১ম সংখ্যা । ] সম্ভাবনামাত্র নাই। আকস্মিক ঝড় বৃষ্টি বান তুফান হইতে আত্মরক্ষার চেষ্টা-সেই চেষ্টা সফল দেখিয়া যে শক্তিবৃদ্ধি, সন্মানবুদ্ধি, মর্য্যাদাবৃদ্ধি ঘটে, ভূগোলবিবরণ ও স্বাস্থ্যরক্ষা আগাগোড়া কণ্ঠস্থ করিলেও তাছার তুল্য হয় না। আট বৎসরের বালক —যাহার উপর কৃষক পরিবারের সর্বস্ব ধন গাভীগুলির রক্ষা কাৰ্য্য সমর্পিত আছে, সেই গাভীগুলিকে খোলা মাঠে ছাড়িয়া দিয়া, গাছের ডগার উপর হইতে তাহাদের গতিবিধির উপর নজর রাথিয়া, তাহাদের গায়ের রঙ ও গলার ডাকের সহিত পরিচিত হইয়া, ঝড় জল ও বাঘের মুথের উপস্থিত বিপদ হইতে তাহাদিগকে বঁাচাইয়া আনিয়া দিনাস্তে আপন আপন ঘরে ফিরিয়া আসা—এই বৃহৎ কার্য্য স্বসম্পন্ন করিয়া, এই বৃহৎ দায়িত্বের ভার দিনের পর দিন বহন করিয়া, তাহার মনুষ্যত্বে যে বালাধান হয়, তাহার আত্মমর্য্যাদা যেমন ফুটয় উঠে, তাহার কৰ্ত্তবাবুদ্ধি যেরূপ জাগ্রত হইয়া উঠে, কোন পাঠশালার কোন শিক্ষার তাহার নিকটে পোছাইতে পারে । বর্তমান কালের প্রাইমারি ইস্কুলে বিদ্যালাভ করিয়া বামন কায়েতের ছেলে সঙ্গতি থাকিলে ইংরেজি পড়িতে যায়, ও শেষ পর্যন্ত তাহদের অনেকের একটা সদগতি হয়। কিন্তু চাষার ছেলে, তাতির ছেলে, মুদির ছেলে, যাহাদের জন্ত মুখ্যতঃ এই লোকশিক্ষা, তাহাদের পরিণামটা একবার চিন্তনীয়। প্রাইমারি ইস্কুল হইতে বাহির হইয়া অর্থাভাবে তাহারা ইংরাজি ইস্কুলে প্রবেশ করিতে পারে না ; এদিকে চাষার ছেলে লাঙ্গল ধরিতে, তাতির ছেলে তাতে বসিতে ও মুদির ছেলে তুলদাড়ি হাতে লইতে লজ্জা বোধ করে। এগ্‌জামিন পাশ করিয়া তাহারা ভদ্রলোকে পরিণত তাহার হইয়াছে ; জুতা জামা ছাতা ব্যবহারে অভ্যস্ত হইয়৷ "ইতর” কাজে হাত দিতে পারে না। অগত্যা তাহার উকিলমহাশয়ের মুহুরি বা আদালতের পেয়াদী হইয়া জামা জুতা ছাতার কড়ি যোগাইবার জন্য ঘুষ খায় এবং ঘুষের পয়সায় মদ খাইতে ধরে ; যাহাঁদের এই কৰ্ম্মও ন৷ জুটে সে নিতান্ত অকৰ্ম্ম হইয়া যাত্রার দল করে ও গাজ খায়। প্রাইমারি ইস্কুলে অর্জিত বিদ্যার অধিকাংশ ছেলের এই পরিণাম । লোকশিক্ষা । నన ফলে শিক্ষার সাহত আমার বিরোধ নাই, শিক্ষা প্রণালীর সহিত আমার বিরোধ ; শিক্ষা বিড়ম্বনার সহিত আমার বিরোধ, অন্যদেশের কথা উপস্থিত করিবার দরকার নাই, আমাদের দেশে বর্তমানকালে যে শিক্ষাবিড়ম্বন৷ বর্তমান আছে ; তৎসম্বন্ধেই আমি এই প্রসঙ্গ উপস্থিত করিতেছি। যতদিন এই শিক্ষাপ্রণালীর আমূল সংস্করণ না হইতেছে, ততদিন আমি এই শিক্ষাবিস্তারের প্রস্তাবে কিছু আতঙ্ক অনুভব করিব । কিছুদিন পূৰ্ব্বে এদেশের খাটি স্বদেশী পাঠশালায় নিম্নশিক্ষার যে প্রণালী প্রচলিত ছিল, শিশুবোধকের চাণক্য শ্লোকে ও দাতাকর্ণের উপাপ্যানেই যাহার সমাপ্তি ঘটিত, শিশুজন ভয়াকর গুরুমহাশয় যে শিক্ষাপ্রণালীর পরিচালনে সৰ্ব্বতোমুখ প্রভূত্ব নিয়োগ করিতেন, সেই প্রণালীতে নানা দোষ বর্তমান ছিল, সন্দেহ নাই। কয়েক বৎসর মধ্যে এদেশের লোকশিক্ষা একবারে গভমেণ্টের অধীন হইয়াছে ; বড় বড় মনীষী পণ্ডিতের ধীশক্তি এই বিষয়ে নিযুক্ত রহিয়াছে। কিন্তু এই আধুনিক শিক্ষা প্রণালীতে যে সকল দোষ প্রবেশ করিয়াছে, তাহ পূৰ্ব্বের তুলনায় গুরুতর কি না তাহা বিচারের সময় আসিয়াছে। এই শিক্ষাপ্রণালী দোষযুক্ত, তাহা গবর্মেন্ট মানিয়া লইয়াছেন; সংস্কারেরও প্রচুর চেষ্টা হইয়াছে। কিন্তু যে কারণেই হউক, সংস্কারচেষ্টা এখনও কোন ফল লাভ করে নাই। ইনস্পেক্টারের সংখ্যা অতি মাত্রায় বাড়িলেও কোন ফলই এখনও পাওয়া যায় নাই ; বহুস্থলে সংস্কার চেষ্টা হাস্তরসের সৃষ্টি করিয়াছে মাত্র। যতদিন বৰ্ত্তমান শিক্ষাপ্রণালী প্রচলিত থাকিবে, ততদিন কোন বালককে এই শিক্ষাগ্রহণে বাধা করা উচিত কি না, তাহারই বিচারের জন্ত আমি এই প্রসঙ্গ উপস্থিত করিয়াছি। লোকশিক্ষার বিচার আবখ্যক ইহ। স্বতঃসিদ্ধ সত্য, এ সম্বন্ধে আমার কোন বক্তব্যই নাই, কিন্তু শিক্ষার নামে অপশিক্ষার প্রশ্রয় দেওয়া উচিত কি না, তাছাই বিচাৰ্য্য। পাঠাগারের নামে কারাগারে বালকগণকে প্রেরণ করিয়া তাহদের জীবন-শক্তির ধবংস সাধনে উদ্যোগ উচিত কি না, তাহারই আমি মীমাংস চাহিতেছি । ঐরামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী।