পাতা:প্রবাসী (দশম ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Dob মনের রাগ প্রাণপণে মনে চাপিয়া রাথিয় মোহিত শান্তভাবে বলিল—“ওঁরা কি আমাদের অপমান করেন নি ?" মুখ খিচাইয়া গোপী৭াবু বলিলেন--"ওঁরা আমাদের কি অপমান করলেন ? আমাদের মত অবস্থার লোকের ঘরে মেয়ে দেবার প্রস্তাব করেছিলেন, সেটা আমাদের সন্মান না অপমান ?” দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া মোহিত বলিল—“কি করে আপনাকে বোঝাব বলুন ।” “আমাকে বোঝাবে কি করে ? খুলে বল্লেই বোধ হয় আমি বুঝতে পারি। বাঙ্গলা ভাষা আমার মাতৃভাষা— যদি বাঙ্গলা করে বল, তবে হয়ত বুঝতেও পারি। তুমি কি মনে কর আমি এমনি মূর্থ, এমনি গ্রাম্য, এমনি নিৰ্ব্বোধ যে একটা শাদা কথা বুঝতে পারিনে ? তুমি না হয় কলেজে পড়ে অনেক পাস টাস করেছ—আমি সেকেন ক্লাস পর্য্যন্ত পড়েছিলাম মাত্র-কিন্তু এ ত সেক্সপিয়রও নয়, মিণ্টনও নয়,-বেদান্তও নয়, স্মৃতিশাস্ত্রও নয়, তবে কেন বুঝতে পারব না ? একবার বুঝিয়ে বলেই না হয় দেখ না। তাতে কি তোমার মানের কোনও লাঘব আছে না তোমার বিষ্ঠা ক্ষয় হয়ে যাবে ?” ইতিমধ্যে পাচিকাটি গাত্রমার্জন সমাধা করিয়া, একটি জলপূর্ণ ছোট পিতলের ঘড়া কক্ষে লইয়া, হেলিতে ছলিতে বাগানের ছায়ায় ছায়ায় ফিরিয়া আসিতেছিল। নিকটবৰ্ত্তী হইলে একবার বাতায়নের প্রতি উদ্ধদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া, নিজ অনাবৃত মস্তকের উপর কাপড় টানিয়া দিল । এটুকু গোপীকাস্তের চক্ষু এড়াইল না। মোহিত বলিল –“আপনি বল্লেন, আমাদের মত অবস্থার লোকের ঘরে ওঁরা মেয়ে দিতে চেয়েছিলেন। দিতে চেয়েছিলেন কি ? ওঁরা এসেছিলেন আমাকে দেখতে, পছন্দ করতে। আমি যেন বাজারের একটা পণ্যদ্রব্য কিম্বা একটা ঘোড়া, মেলায় বিক্রী হতে এসেছি। দেখে যদি পছন্দ হয় তবে দামের জন্তে আটকাবে না। এটা কি অপমান নয় ? o গোপীকান্ত একটু নরম হইয়া বলিলেন--"ঐ তোমাদের এক কথা !—কেন, এতে অপমানটা কিসের ? বিবাহ স্থির হবার পূৰ্ব্বে পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখে, কষ্ঠাপক্ষ ছেলে দেখে— প্রবাসী—জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭ । t এ ত চিরদিনের প্রথা-চলে আসছে। পছন্দ হয় না হয় এই জন্যেই ত দেখা। যদি উভয় পক্ষের পছন্দ হয়, তথন কথাবাৰ্ত্ত পাকাপাকি স্থির হয়। এতে অপমানটা কি ?" মোহিত নীরবে দণ্ডায়মান রহিল। জানালার বাহিরে প্রকাও জামগাছ । তাহাতে বসিয়া অনেকগুলি শালিক পাপী কিচির মিচির করিতেছে। একটা বানর লম্ফ দিয়া সেই গাছের ডাল ধরিয়া দুলিতে আরম্ভ করিল। পার্থীগুলি উড়িয়া পলাইয়া গেল। একটু নীরব থাকিয়া দাদা বলিলেন—“তুমি বিবাহ করবে না এই কি তোমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ?” “আজ্ঞে হ্যা।” “কেন করবে না শুনতে পাই ?” “ইচ্ছা নাই ।” "এ যে তোমার আজগুবি ইচ্ছা।”—বলিয়া গোপীকান্ত বাবু পালঙ্কের প্রান্তে উপবেশন করিলেন। বলিতে লাগিলেন--“এ যে তোমার স্বষ্টিছাড়া ইচ্ছ। সংসারী লোক,—যে সংসার আশ্রমে থাকবে – তার পক্ষে বিবাহ করাই ধৰ্ম্ম। বিবাহ হচ্ছে হিন্দুর পক্ষে একটা সংস্কারতা কি জান না? এদিকে ত খুব ধাৰ্ম্মিক বলে পরিচয় দাও।” বেচারী মোহিত আজ কাহার মুখ দেখিয়া উঠিয়াছে ঠিকানা নাই। প্রাতঃকাল অবধি ক্রমাগত থিটিমিটিক্রমাগত অপ্রীতিকর মন্তব্য । ধৈর্য্য রক্ষা করিয়া চলা তাহার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিতে লাগিল। তথাপি যথাসম্ভব আত্মসম্বরণ করিয়া বলিল—“সংসারী লোকের পক্ষে বিবাহ করা যে অবগু কৰ্ত্তব্য, সে ধারণা আমার নেই।" একটু বিদ্ধপের স্বরে গোপীকান্ত বলিলেন—“আচ্ছ, যেন বিবাহ নাই করলে । কিন্তু নিজে ঠিক থাকতে পারবে?" মোহিতলাল কোনও উত্তর করিল না। এ প্রশ্নই তাহার অপমানজনক বলিয়া মনে হইল। তাহাকে নিরুত্তর দেখিয়া গোপীকান্ত বলিতে লাগিলেন— “তুমি না হয় খুব লেখাপড় শিখেছ, আমরা মুখ্য মুথু মানুষ। >० २ ७१ । । কিন্তু তোমার চেয়ে আমার বয়স অনেক বেশী, : পৃথিবীকে তোমার চেয়ে আমি অনেক বেশী চিনেছি। ! সংসার সম্বন্ধে তোমার চেয়ে অনেক বেশী জ্ঞানলাভ করেছি, ২য় সংখ্যা । ] এ কথা জোর করে বলতে পারি। তোমার মত বয়সের সংসারী লোকের পক্ষে, বিবাহ করা অত্যাবশ্যক। তুমি যদি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যেতে, গৃহস্থাশ্রমে না থাকতে, তবে সে অন্ত কথা ছিল। কিন্তু গৃহস্থাশ্রমে থেকে তার নিয়ম প্রতিপালন করবে না, এর কুফল অবশুম্ভাবী। আমার মতে, তুমি যদি বিবাহ কর, তাতে তোমার ধৰ্ম্মচর্চার ক্ষতি হবে না। যদি অবিবাহিত থাক, তাতেই হানি হবার বিশেষ সম্ভাবনা । বিবাহ করেও অনেকে নিৰ্ম্মল থাকতে পারে না। তুমি বিবাহ না করেও নিৰ্ম্মল থাকবে যদি বল, সেটা শুধু তোমার ভণ্ডামি। য়ানের ঘাটে স্ত্রীলোকের প্রতি পাপ দৃষ্টি করার চেয়ে বিবাহ করা ভাল।” শেষ কথাগুলিতে মোহিত লালের কোপাগ্নি দাউ দাউ করিয়৷ জলিয়া উঠিল । বাক্য সংযম হারাইয়া হটাৎ সে বলিয়া ফেলিল—“সবাইকে নিজের মত মনে করবেন না।" এই কথায় গোপীবাবু পালঙ্ক হইতে ভূমে অবতরণ করিয়া রোধে গর্জিয় কহিলেন—“কী ! যতবড় মুখ ততবড় কথা ?” মোহিত ধীর ভাবে বলিল—“মিছে আমায় চোখ রাঙাচ্ছেন। আমি সব জানি।” গোপীবাবু পূৰ্ব্ববং কহিলেন–“কি জান?” “যা জানি, তা বলে আর নিজের মুখকে কলঙ্কিত করব না। কিন্তু আপনি সাবধান হবেন। আপনি যদি স্বেচ্ছায় মন্দ সংসর্গ পরিত্যাগ না করেন, তবে তার প্রতিকার আমার নিজের হাতে নিতে হবে।” গোপীবাব একটু দ্বিধায় পড়িয়া গেলেন। মোটিত কি জানে এবং কতখানি জানে, কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। সর্পভীত মনুষ্য অন্ধকারে যেমন সাবধানে পদক্ষেপ করে, সেইরূপ সাবধানতা অবলম্বন করিয়া নরম হুরে বলিলেন— “বটে!—তুমি আমার অভিভাবক নাকি ? গুরুজন ?” “না—গুরুজনও নই, অভিভাবকও নই। আমি আপনার ছোট ভাই। ছোট ভাইকে অধৰ্ম্ম পথ থেকে নিবৃত্ত করা সম্বন্ধে, বড় ভাইয়ের যেমন অধিকার, বড় ভাই সম্বন্ধে ছোট ভায়েরও ঠিক সেই রকম অধিকার : যেন গোপী বাবু কিছুমাত্র চিন্তিত হন নাই—শঙ্কিত হন নবীন সন্ন্যাসী । ు 6న নাই—এইরূপ ভাবটা অবলম্বন করিয়া বলিলেন—“বটে ! এ যে নতুন শাস্ত্ৰ শুনছি। তা, কি করতে চাও তুমি ?” মোহিত গম্ভীর ভাবে বলিল—“এখনও স্থির করিনি। আপনি যদি সহজে সৎপথে না আসেন, তবে আমাকে অপ্রীতিকর উপায় অবলম্বন করতে হবে।" যুবকের মুখে চক্ষে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। দেখিয়া গোপীকান্ত একটা অনির্দিষ্ট উৎকণ্ঠায় বিবর্ণমুখ হইয় গেলেন। পুনৰ্ব্বার সমীপবর্তী পালঙ্কে উপবেশন করিয়া, বাম হস্তের দ্বারায় আপনার দুই চক্ষু আচ্ছাদিত করি।” উৎপীড়িত ধাৰ্ম্মিকের মত বলিতে লাগিলেন-- “তা হবেই ত! না হবে কেন ? কলিকাল কিনা। একালে সবই উণ্টে। পূৰ্ব্বে ছোট ভাই, বড় ভাইকে পিতার মত গুরুর মত ভক্তি করত। একালে ছোট ভাই বড়কে ধৰ্ম্মোপদেশ শোনায়, তাকে সংশোধন করবার চেষ্টা করে, নানা রকমে শাসায় ! এ নৈলে আর কলিকাল বলবে কেন ? পূৰ্ব্বে ছিল, গুরুনিন্দ মহাপাপ। গুরুনিন্দ করলে লোকের জিহবা খসে যেত। এখন আর গুরু লঘু কেউ নেই। সবাই স্ব স্ব প্রধান। তবে উঠি । এখন আর তোমার সময় নষ্ট করব না। পাপীর সংসর্গে থাকা তোমার ভাল নয়।”—বলিয়া গোপীবাবু পালঙ্ক হইতে অবতরণ করিয়া দ্বারোদঘাটন করিয়া বাহির হইলেন। দ্বারের বাম দিকেই নীচে নামিবার সিড়ি। দেখিলেন তাহার স্ত্রী সেই সিড়ি দিয়া দ্রুতভাবে অবতরণ করিতেছেন। বাহিরে বৈঠকখানায় গিয়া দেখিলেন, একটি মধ্যবয়স্ক অপরিচিত ব্যক্তি, পরিধানে নুতন কাপড়, নূতন চাদর, নুতন জাম, নূতন জুতা, বগলে একটি নূতন ছাতি, এক হাতে একটি পুটুলি অন্ত হাতে একটি থেলো ছক লইয়া দাড়াইয়া আছে। লোকটির মাথায় টাক। গোফগুল নেল খোচা। বর্ণটি মসীনিন্দিত। গোপীবাবুকে দেম্বিয়াই সে ব্যক্তি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিল। গোপীবাবু বলিলেন—“কে তুমি ?” লোকটি উত্তর করিল—“আজ্ঞা, আমার নাম শ্ৰীগদাধর পাল।” - - “বাড়ী কোথায় ?" -