কবি মনোমোহন বসু ঐপ্রিয়রঞ্জন সেন, এম-এ উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে, বিশেষতঃ বিংশ শতাব্দীর প্রথমটায়, নাট্যকার গিরিশচন্দ্র বাংলার এতখানি জায়গা জড়িয়া ছিলেন যে আমরা, তাহার পাশে যে-সব রথীমহারথী দাড়াইয়াছিলেন র্তাহাদের দিকে দৃষ্টিপাত করি নাই। নাটক-রচনাকৌশলে, স্বয়ং অভিনয়পটুতায় এবং অন্যান্য অভিনেতার শিক্ষাবিধানে, বাংলার রঙ্গমঞ্চ তিনি যেমন নূতন ভাবে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন তাহাতে র্তাহার সমসাময়িক আর সকলের কথা আমাদের ভুলিয়া যাইতে হয় । কিন্তু কাল সৰ্ব্বগ্রাসী, লোকক্ষয়কারী ; কালপ্রভাবে প্রতিভার ভাস্বর জ্যোতিও স্নান হয় ; কালচক্রের গতিমাহাক্স্যে একদিকে যেমনই গিরিশচন্দ্রের মূৰ্ত্তি আমাদের স্মৃতিপটে স্নান হইয়া পড়িবে অন্যদিকে তেমনই আবার তাহার সঙ্গী ও সহকৰ্ম্মী বহু কৃতী নাট্যকারের ছবি আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হইবে ; তাহাদের একজনের কথা আজ আলোচনা করিতে চাই ; তাহার নাম ছিল মনোমোহন বস্ত্ৰ । - বঙ্গাব্দ ১২৩৪ সালের আষাঢ় মাসে চব্বিশ-পরগণার ছোটজাগুলিয়া গ্রামে মনোমোহনের জন্ম। যশোহর জেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামে মাতুলালয়ে তাহার শৈশব অতিবাহিত হয় ; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতা তাহার এই সময়ে সহজসাধ্য ছিল। নিশ্চিন্তপুর পাঠশালায় পড়িয়া তিনি জন্মস্থানে ফিরিয়া আসেন। মনোমোহন পিতার তৃতীয় পুত্র ; অল্পবয়সেই তিনি পিতৃহীন হন; র্তাহার খুল্লতাত চন্দ্রশেখর বস্থ তাহার অভিভাবক ছিলেন । যখন কলিকাতায় পড়িতে আসেন, তখন তিনি ডেভিড হেয়ার ও রিচার্ডসন সাহেবের নিকট বিদ্যাশক্ষার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিলেন। তিনি জেনারেল স্বাসেম্বলী ইন্ষ্টিটিউশনে—এখন যাহা স্কটিশ চার্চ কলেজ নামে পরিচিত—পড়িতেন এবং উচ্চশ্রেণীতে পড়িবার সময় বাংলা প্রবন্ধ লিখিয়া শিক্ষকমহলে প্রতিপত্তি লাভ করেন, অনাবশ্বক শব্দবজন ও প্রাঞ্চল রচনার ছুনা মূল্যবান স্বর্ণপদক ও ইংরেজী পুস্তক পারিতোষিক প্রাপ্ত হন। তখনকার পত্রিকামহলেও বাংলা রচনার জন্য তরুণ লেখক মনোমোহনের আদর হয়, ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় র্তাহার লেখা বাহির হইতে লাগিল, পরে কবিবর নিজেই বিভাকর নামে এক সাপ্তাহিক পত্র প্রকাশ করেন । এই সময়ে কবির জীবনে এক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। কবি ঈশ্বর গুপ্ত তখন কাশীধামে ছিলেন ; মনোমোহনকে তখন গুপ্ত-কবির শিক্ষানবীশ বলা চলে, তিনিও কৰ্ম্মোপলক্ষে কাশীতে আসিয়াছিলেন। কাশীবাসী সাধারণ ঈশ্বর গুপ্তের কবিপ্রতিভার সাক্ষাৎ পরিচয় পাইবার জন্য ব্যস্ত হইল, কবিকে তাহারা নিজেদের প্রার্থন জানাইল । কিন্তু প্রতিপক্ষ না পাইলে সঙ্গীত জমিবে না বলিয়া তিনি তাহাদিগকে মনোমোহনকে ধরিবার কথা বলিলেন । গুরুশিষ্যে কবিত্বের পরীক্ষণ হইল, গুরুর অতুমতি ও আশীৰ্ব্বাদ লইয়া শিষ্য সংগ্রামে লিপ্ত হইলেন, গুরু হার মানিয়া শিয্যকে আশীৰ্ব্বাদ করেন,—“সঙ্গীতসংগ্রামে বিজয়ী হও।” এই ঘটনার মধ্যে শিয্যের কৃতিত্বের সঙ্গে গুরুর প্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়,—সেই পুরাতন কথা মনে করাইয়া দেয়,—“সৰ্ব্বত; জয়মন্বিচ্ছেৎ শিষ্যাদিচ্ছেৎ পরাজয়ম্।” তখনকার দিনে ছোটজাগুলিয়ায় উন্নতির হাওয়৷ বহিতেছিল ; সভ্যতা তখনও নগরে সম্পূর্ণভাবে আবদ্ধ হয় নাই, পল্পীজীবনে একটা চঞ্চলত ছিল, লীলায়িত গতি ছিল । স্থানীয় অবৈতনিক নাট্যসমাজ সাধারণের নাট্যরসপিপাসা দূর করিত। অমুকুল বাতাসে মনোমোহনের নাট্যপ্রতিভা স্ফুর্ভূি পাইল, বাঙালী পাঠক নাট্যশালার উন্নতির যুগে নূতন নূতন আহার পাইয়া তৃপ্তি
পাতা:প্রবাসী (দ্বাত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১৯৫
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।