বৈশাখ অরণ্য-কাণ্ড vg4 ধ্বনাশ করিল, সব জানাজানি হইয়া গেল !...কিন্তু কান্না থামিল না। নিঃশ্বাস রোধ করিয়া ঐ অতল জলতলে শ’ বছরের জরাজীর্ণ ময়ুরপঙ্গীর কামরার মধ্যে যে ধুরীমতী রাজবধু সারাদিনমান অপেক্ষা করে, গভীর তে এইবার সে ঘোমটা খুলিয়া বাহিরে আসিয়া নিত্যকার মত উৎসবে যোগ দিতে চায়। যেখানে শঙ্কর প। ঝুলাইয় বসিয়াছিল, তাহার কিছু নীচে জলে-ডোবা সিড়ির ধাপে মাথা কুটিয়। কুটিয়া বোবার মত সে বড় কান্না কাদিতে লাগিল । তারপর কখন চাদ ডুবিয়া দীঘিজল আঁধার হইল, বাতাসও একেবারে বন্ধ হইয় গেল, গাছের পাতাটিরও কম্পন নাই—কান্না তখনও চলিতেছে । অতিষ্ঠ হইয়া কাহার। দ্রুতহাতে চারিদিকে অন্ধকারের মধ্যে ঘন কালে পদা খাটাইয়া দিতে লাগিল—শঙ্কর বসিয়া থাকে, থাকুক— তাহাকে কিছুই উহারা দেখিতে দিবে না। আবার টঙ্ক টিপিয়৷ চারিদিক ঘুরাইয়া ঘুরাইয়৷ দেপিল । আলে জালিতে না জালিতে গাছের আড়ালে কি কোথায় সব যেন পলাইয়া গেল, কোনদিকে কিছু নাই । তখন সে উঠিয় দাড়াইল । মনে মনে কহিতে লাগিল—আমি চলিয়া যাইতেছি, তুমি আর কাদিও না হে লজ্জারুণ রাজবধু, মৃণালের মত দেহখানি তুমি দীঘির তল হইতে তুলিয়া ধর, আমি তাহ দেখিব না। অন্ধকার রাত্রি, অনাবিষ্কৃত দেশ, অজানিত গিরিগুহ, গভীর অরণ্যভূমি এসব তোমাদের । অনধিকারের রাজ্যে বসিয়া থাকিয়া তোমাদের ব্যাঘাত ঘটাইয়। কাদাইয়া গেলাম, ক্ষম করিও— যাইতে যাইতে আবার ভাবিল, কেবল এই সময়টুকুর জন্য র্কাদাইয়া বিদায় লইয়া গেলেও না হয় হইত। তাহ। ত নয়। সে যে ইহাদের একেবারে উদ্বাস্তু করিতে এখানে আসিয়াছে। জরীপ শেষ হইয়। একজনের দখল দিয়া গেলে বন কাটিয়া লোকে এখানে টাকা ফলাইবে। এত নগর-গ্রাম মাঠ-ঘাটেও মানুষের জায়গায় কুলায় না, তাহারা প্রতিজ্ঞ করিয়া বসিয়াছে পৃথিবীতে বন-জঙ্গল এক কাঠা পডিয়া ঋকিতে দিবে না, তাই শরকে নােপূড়ি নি, জামিনের দলবল যন্ত্রপাতি নক্স কাগজ পত্ৰ দিয়া ইহাদের এই শত শত বৎসরের শাস্ত নিরিবিলি বাসভূমি আক্রমণ করিতে পাঠাইয়া দিয়াছে। শাণিত খড়েগর মত ভজহরির সেই সাদা সাদা দাত মেলিয়া হাসি—উৎপাত কি আমরা কম করছি হুজুর ? সকাল নেই, সন্ধ্যে নেই, কম্পাস নিয়ে চেন ঘাড়ে করে করে’. কিন্তু মাথার উপরে প্রাচীন বনস্পতির ভ্ৰকুটি করিয়া যেন কহিতে লাগিল—তাই পারিবে নাকি কোন দিন ? আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া তাল ঠুকিয়া জঙ্গল কাটিতে কাটিতে সামনে ত আগাইতেছ আদিকাল হইতে, পিছনে পিছনে আমরাও তেমনি তোমাদের তাড়াইয়৷ চলিয়াছি। বন-কাটা রাজ্যে নূতন ঘর তোমরা বাধিতে থাক, পুরাণে। ঘর-বাড়ী আমরা ততক্ষণ দখল করিয়া বসিব ।. হা-হা-হা হা-হ। তাহাদেরই হাসির মত আকাশে পাখী ঝাপটাইতে ঝাপটাইতে কালো কালো এক ঝাক বাদুড় বনের উপর দিয়া মাঠের উপর দিয়া উড়িতে উড়িতে গ্রামের দিকে চলিয় গেল ।. বনের বাহির হইয়। শঙ্কর ঘোড়ায় চাপিল । ঘোড়া আস্তে আস্তে হঁাটাইয়া ফিরিয়া চলিল। পিছনের বনে ডালে ডালে ঝাক-বাধা জোনাকী, আমের গুটি ঝরিতেছে তার টুপটাপ শব্দ, অজানা ফুলের গন্ধ...বারবার পিছন দিকে সে ফিরিয়া ফিরিয়া তাকাইতে লাগিল । অনেক দূরে কোথায় কুকুর ডাকিতেছে, কাহাদের বাড়ীতে আকাশ-প্রদীপ আকাশের তারার সহিত পাল্লা দিয়া দপদপ করিতেছে ; এইবার গিয়া সেই নিরাল তাবুর মধ্যে ক্যাম্প খাটটির উপর পড়িয়া পড়িয়া ঘুম দিতে হইবে। যদি এই সময় মাঠের এই অন্ধকারের মধ্যে স্থধারাণী আসিয়া দাড়ায়.কপালে জলজলে সিদুর, একপিঠ চুল এলাইয়া টিপিটিপি দুটামীর হাসি হাসিতে হাসিতে যদি স্বধারাণী ঘোড়ার লাগাম ধরিয়া সামনে আদিয়া দাড়ায়, দাড়াইয়া দুই চোখ ভুরিয়া তার দিকে তাঙ্কাইয়া থাকে মাথার উপর তারাভরং আকাশ, বেলুঙ্গি কেউ নাই—মােড় হইতে গাই৷ পড়িয়৷
পাতা:প্রবাসী (দ্বাত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪৭
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।