পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৭৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ফাস্তুন শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে সংগীতের স্থান ՊՏՏ সুপীত সৰ্ব্বদা কানে পৌছত চারদিকের লোকের, গানের সুর-সেচনে বাতাস হ’ত অভিষিক্ত । সঙ্গীতে যার স্বাভাবিক অম্বুরাগ ও ক্ষমতা ছিল সে পেত প্রেরণ, তাতে তার শিক্ষার হ’ত ভূমিকা। যে-সব ধনীদের ঘরে বৃত্তিভোগী গায়ক ছিল, তাদের কাছে শিক্ষা পেত কেবল ঘরের লোক নয়, বাইরের লোকও । বস্তুত এই সকল জায়গা ছিল উচ্চ সঙ্গীত শিক্ষার ছোট ছোট কলেজ। বিখ্যাত বাঙালী সঙ্গীতনায়ক যদুভট্ট যখন আমাদের জোড়াসাকোর বাড়িতে থাকতেন নানাবিধ লোক আসত তার কাছে শিখতে ; কেউ শিখত মৃদঙ্গের বোল, কেউ শিখত রাগরাগিণীর আলাপ । এষ্ট কলরবমুখর জনসমাগমে কোথাও কোনো নিষেধ ছিল না। বিদ্যাকে রক্ষা করবার ও ছড়িয়ে দেবার এই ছিল সহজ উপায় । এই তো গেল উচ্চ সঙ্গীত। জনসঙ্গীতের প্রবাহ সেও ছিল বহু শাখায়িত। নদীমাতৃক বাংলা দেশের প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে যেমন ছোট-বড় নদী-নালা স্রোতের জাল বিছিয়ে দিয়েছে, তেমনি বয়েছিল গানের স্রোত নান ধারায় । বাঙালীর হৃদয়ে সে রসের দৌত্য করেছে নানা রূপ ধরে । যাত্র, পাচলি, কথকতা, কবির গান, কীৰ্ত্তন মুখরিত করে রেখেছিল সমস্ত দেশকে । লোকসঙ্গীতের এত বৈচিত্র্য শর কোনো দেশে আছে কি না জানিনে। সর্থের যাত্রা স্বষ্টি করার উৎসাহ ছিল ধনী সস্তানদের । এই সব নানা অঙ্গের গান ধনীরা পালন করতেন, কিন্তু অন্যদেশের বিলাসীদের মতো এ সমস্ত র্তাদের ধনমৰ্য্যাদার বেড়া-দেওয়া নড়তে নিজেদেরই সম্ভোগের বস্তু ছিল না। বাল্যকালে ধামাদের বাড়িতে নলদময়ন্তীর যাত্রা শুনেছি। উঠোনগছ: জাজিম ছিল পাত, সেখানে যারা সমাগত তাদের মধিকাংশই অপরিচিত, এবং অনেকেই অকিঞ্চন, তার প্রমাণ পাওয়া যেত জুতো চুরির প্রাবল্যে । আমার পিতার রিচ ছিল কিশোরী চাটুজে। পূৰ্ব্ব বয়সে সে ছিল কালে পাচলির দলের নেতা । সে আমাকে প্রায় বলত, ই"ি, তোমাকে যদি পাচলির দলে পাওয়া যেত তা হ’লেকি? আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারত না। বালক ৪িরও মন চঞ্চল হয়ে উঠত পাচলির দলে খ্যাতি অর্জন বি” অসম্ভব দুরাশায়। পাচলির যে গান তার কাছে গুনতুম তার রাগিণী ছিল সনাতন হিন্দুস্থানী, কিন্তু তার স্বর বাংলা কাব্যের সঙ্গে মৈত্রী করতে গিয়ে পশ্চিমী ঘাঘরার ঘূর্ণবৰ্ত্তকে বাঙালী শাড়ীর বাহুল্যবিহীন সহজ বেষ্টনে পরিণত করেছে – “কাতরে রেখে রাঙা পায় মা, অভয়ে, দীনহীন ক্ষীণ জনে যা করে মা, নিজগুণে, তারিতে হবে অধীনে, আমি অতি নিরূপায়।” –এই স্বর আজো মনে পড়ে। স্বয্যের কিরণচ্ছটা বহু লক্ষ যোজন দূর পর্য্যস্ত উৎসারিত হয়ে ওঠে, এই তার তানের থেলা । আর আমার শুমা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল প্রভাতের রূপোলী কস্ক। আর স্বয্যাস্তকালের সোনালী জরির অচলা নিয়ে তন্ত্রীর গায়ে গায়ে ঘিরে ধিরে দক্ষিণ হাওয়ায় কাপতে থাকে। কিন্তু এও তো ঐশ্বৰ্য্য, এও তো চাই ।

  • ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসি নে” । এতে তানের প্ৰগলভত নেই কিন্তু বেদন আছে তো । এও যে নিতান্তই চাই সাধারণের জন্যে। শুধু সাধারণের জন্যে কেন বলি, এক সময়ে উচ্চ ঘরের রসনাও তৃপ্তির সঙ্গে এর স্বাদ গ্রহণ করেছে। মেয়েদের অশিক্ষিতপটুত্বের কথা কালিদাস বলেছেন, সরল প্রকৃতির লোকের অশিক্ষিত স্বাদ সম্ভোগের কথাটাও সত্য। যে ঘরের পাকশালার দূর পাড়া পৰ্য্যস্ত মোগলাই ভোজের লোভন গন্ধে আমোদিত, সেই ধরেই বিধবা মাসৗমার রাধা মস্লা-বিরল নিরামিষ ব্যয়নের আদর হয়ত তার চেয়েও নিত্য হয় –

"মনে রইল সই মনের বেদন, প্রবাসে যখন যায় গে। সে তারে বলি-বলি আর বলা হোলো না ।”— এ যে অত্যন্ত বাঙালা গান। বাঙালীর ভাবপ্রবণ হৃদয় অত্যন্ত তুষিত হয়েই গান চেয়েছিল, তাই সে আপন সহজ গান আপনি স্পষ্ট না ক’রে বঁাচেনি । তাই আজো দেখতে পাই বাংলা সাহিত্যে গান যখন তখন যেখানে সেখানে অনাহূত অনধিকারপ্রবেশ করতে কুষ্ঠিত হয় না। এতে অন্যদেশীয় অলঙ্কারশাস্ত্রসম্মত রীতি ভঙ্গ হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের রীতি আমাদেরই স্বভাবসঙ্গত। তাকে ভৎসনা করি কোন প্রাণে ? সেদিন আমাদের নটরাজ শিশির ভাদুড়ী মশায় কোনো শোকাবহ