পাতা:প্রবাসী (পঞ্চত্রিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৯২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বন্যাসঙ্গিনী শ্ৰীপ্ৰবোধকুমার সান্তাল ষ্টেশন থেকে কিছুদূরে ট্রেন দাড়াল। এদিকটায় এখনও বস্তার জল এসে পৌছয় নি। ষ্টেশনে জায়গা কম, নিরাশ্রয় বুহুঙ্কু জনতা আজ চার দিন হ’ল ওখানকার এলাকায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। তা ছাড়া পানীয় জল নোংরা, মাষ্টারমশায় সাবধান ক’রে দিয়েছেন । দুর্ভিক্ষ আর মড়ক আরম্ভ হয়ে গেছে । এক দল স্বেচ্ছাসেবক গাড়ী থেকে লাইনের পারে মেমে পড়ল। এর পরের গাড়ীতে চাল ডাল আলু কাঠ কাপড় আর কলের ও ম্যালেরিয়ার ঔষধ এসে পড়বে এমন ব্যবস্থা করা আছে। তার জন্য এখানেই কোথাও অপেক্ষায় থাকতে হবে । বহু জায়গায় সেবাসমিতির কেন্দ্র খোলা হয়েছে । কিন্তু চারিদিকে চেয়ে যতদূর দৃষ্টি চলে দেখা গেল, কেবলমাত্র জলামাঠ, বিনষ্ট ধানের ক্ষেত, কোন কোন গ্রামের অস্পষ্ট চিহ্ন । আর কিছু না । রেলপথের বাধের ওপর ঝড়ের মত তীব্র বাতাস সমৃ সন ক'রে বয়ে চলেছে । নবীন বধু কিয়ৎক্ষণ এদিক-ওদিক চেয়ে বললেন নদীট পশ্চিম দিকে, নয় ? স্বেচ্ছাসেবকরা মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগল। কেউ জানে না নদী কোন দিকে। মাষ্টার-মশাই ছাড়া আর সবাই অনভিজ্ঞ । নবীন বাবু পুনরায় বললেন শুনতে পাচ্ছ দূরে জলের উচ্ছ্বাস ? বোধ হয় ঐদিকে, ঐ যেন দেখা যাচ্ছে, নয় ? ঐদিক থেকেই ত ঝড় আসছে। ওটা বোধ হয় মেঘ, কেমন ? g কেউ আর উত্তর দিল না। সকলের কৌতুহলী চক্ষু কেবল চিস্তাফুল হ’য়ে দিগন্ত-বিস্তার জলামাঠের দিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল। সুরেশ্বর পশ্চিম দেশের ছেলে, বন্যার অভিজ্ঞতা বিশেষ তার নেই। সে বললে মাষ্টার-মশাই, আমাদের থাকার ব্যবস্থা কোথায় হবে ? মামুষের চিহ্নও ত কোথাও নেই। নবীন বাবু হাসলেন। বললেন--থাকবার জন্যে ত আস নি হে, এসেছ কাজ করতে। আমাদের অনেককেই ভেলার ওপরে ভেসে রাত কাটাতে হবে। কুড়ি সালের বন্যার চেহারা যদি তুমি দেখতে হে - -—আমরা যাব কোন দিকে এখন ? - চল, লাইনের পশ্চিম দিক দিয়েই যাবার চেষ্টা করি । কি বল হে অবনী,-—তুমি দেখছি ভয় পেয়ে গেছ । সকলের সঙ্গেই নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু কিছু আসবাব ছিল। সেগুলি সবাই পিঠের দিকে তুলে নিলে। অবনী কয়েক পী এগিয়ে গিয়ে বললে--ভয় নয় মাষ্টার-মশাই, ভাবছি সাতারটা শিখে নিয়ে ভলাটিয়ারি করতে এলেই ভাল হ’ত । অন্যান্য ছেলেরা হেসে উঠে বললে - এইটেই ত ভয়ের চেহার অবনীবাবু। পশ্চিম দিকে পথ নেই। ষ্টেশন ঘুরেই যেতে হবে, লঙ্গলে পথের দাগ পাওয়া যাবে না। সবেমায় এক পশল বৃষ্টি হয়ে গেছে, পথ পিছল । বেলা জানা যায় না, হয়ত বারোটা হবে। ঘন মেঘে আকাশ পরিব্যাপ্ত। মাঝে মাঝে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে শকুনির পাল । স্বেচ্ছাসেবকের দল কেমন যেন ভারাক্রান্ত মনে রেলপথ ধ'রে চলতে লাগল । কুড়ি সালের বন্যায় এসেছিলুম স্বেচ্ছাসেবক হয়ে। -- নবীন বাবু বলতে লাগলেন, তখন কলেজে পড়ি। তমলুকের এক গ্রামে যে দৃগু দেখেছি, ভুলব না কেনুদিন। সবাই চলতে চলতে র্তার কথায় উৎকর্ণ হয়ে রইল । তিনি বললেন, -বছর কুড়ি বাইশ বয়সের একটি মরা মেয়েকে একটা প্রকাগু বাঘ ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। আশ্চৰ্য্য এই যে, বাঘটাও বানের জলে ভাসা, দুর্ভিক্ষপীড়িত। থানার জমাদারকে ডেকে এনে বন্দুক দিয়ে সেটাকে মারা হ’ল--- একটি গুলিতেই ঠাও ! যেন বসেছিল সে মরবারই অপেক্ষায়। ও সে দৃগু কখনও ভুলব না।