পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

〉めbr তাহাতে সন্দেহ কি ? কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, তাহার পর আর এইরূপ মহাকাব্য হইল কই ? যদি বল, মহাকাব্য কি রোজ রোজ হয় ? হয় ন সত্য, কিন্তু সে দিকে চেষ্টা কই ? ও পথটা যেন লোকে ছাড়িয়াই দিয়াছে বলিয়া মনে হয়। এখন মনে হয় যেন, বেশী দিন ভাবিয়া, বেশী দিন চিন্তিয়া বড় একখানা কাব্য লিথিয়া জীবন সার্থক করিব—সে চেষ্টাই লোকের মনে নাই। চটকদার দু চারটা গান লিম্বিয়া চট করিয়া নাম লইব, সেই চেষ্টাই যেন অধিক । গানের দিকে, ছোট ছোট কবিতার দিকে, চুট কীর দিকেই লোকের ঝোক বেশী। উহাদের কবি আছে—চিরকালই থাকে, আমাদের দেশেও আছে। চুট কাঁতে সময় সময় মুগ্ধও করে, কিন্তু চুটকাই কি আমাদের যথাসৰ্ব্বস্ব হইবে ? বড় জিনিস কি আর হইবে না? আমাদের সাহিত্যের খুব শ্ৰীবৃদ্ধি হইতেছে, তাহাতে আমরা আনন্দিত। বাঙ্গলায় যত বই বাহির হয়, ভারতবর্ষের আর-কোন ভাষায় তত হয় না। এটা আমাদের আনন্দের বিষয়। বাঙ্গলার যত বই অন্য ভাষায় তর্জমা হয়, এত ভারতবর্ষের অন্য ভাষার হয় না। ইহাও আমাদের আনন্দের বিষয়। রবিবাবু "নোবেল প্রাইজ" পাইলেন, বাঙ্গল ভাষার জয়জয়কার হইল ; ইহাতে কে না আনন্দিত। কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করি, ভবিষ্যতের কি হইতেছে ? ঝোক যদি চুট কীর উপর হয়, ক্রমে সে চুট কীও যে খারাপ হইয়া যাইবে। কালিদাস ও ভবভূতির পর চুট কী আরম্ভ হইয়াছিল ; কেননা, শতক, দশক, অষ্টক, সপ্তশতী—এইসব ত চুটকী-সংগ্রহ ছাড়া কিছুই নয়। তাই আমার ভয় হয় পাছে বাঙ্গলার কাব্যটা চুট কীতেই অবসান হইয়া যায়। পদ্য ও কাব্যের ইতিহাস খুব প্রাচীন হইলেও বাঙ্গলা নাটকের ইতিহাস তত প্রাচীন নয়। ছাপাখান হইবার অনেক পরে নাটক আরম্ভ হয়। নাটকের মহারথীগণ একে একে অস্তগত হইয়াছেন। যাহারা আছেন, তাহারাও প্রাচীন হইয়াছেন। কিন্তু এখানেও দেখিতেছি ঐ ব্যাপার —লোকে যেন বেশী দিন ভাবিয়া বই লিখিতে চান না। বই পড়িলেই বোধ হয়, তাড়াতাড়ি করিয়া ছাপাইয় নাম লইবার চেষ্টা। একজন প্রাচীন নাটককার বলিলেন, “আমি দশ বৎসর ধরিয়া রত্নাবলী'খানিকে. বাঙ্গাল প্রবাসী—বৈশাখ, ১৩২২ কথানি সেকেলে বই আছে, প্রায়ই তৰ্জম। বাঙ্গালী [ ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড করিবার চেষ্টা করিতেছি, ঠিক মনের মত হইয়া উঠিতেছে ন।" কিন্তু আবার দেখিতেছি অনেকে তিন মাস অঞ্জ একখানি করিয়া নাটক থিয়েটারে জোগান দিতেছেন। এক-একবার মনে হয় যেন, কিছুদিন নাটক লেখা বন্ধ । করিলে ভাল হয় । নবেলেও সেইরূপ দেখিতে পাইতেছি। নবেলের ইতিহাসও বেশী প্রাচীন নয়। কিন্তু এখানেও ঐ ভাৰ । হইয়া উঠিয়াছে। বঙ্কিমবাবু দুই বৎসরের কমে একখানি । নবেল লিখিতেন না। কিন্তু এখন হু হু করিয়া নবেল । বাহির হইতেছে। এখানেও দেখিতে পাই, চুটকীয় অধিক। চুট কী যে মন্দ, তাহ বলিতেছি না। অনেক ? চট কী অতি সুন্দর, বেশ মনে লাগে। অনেক সম । চুটকাই কি আমাদের যথাসৰ্ব্বস্ব হইবে। চুট কীর একটি দোষ আছে—যখনকার তখনই, বেশী দিন থাকে না। একখান বই পড়িলাম, অমনি আমার মনের ভাব আমূল । পরিবর্তন হইয়া গেল, যতদিন বাচিব ততদিন সেই বইয়ের কথাই মনে পড়িবে এবং সেই আনন্দেই বিভোর হই। থাকিব—এ রকম ত চুটকীতে হয় না। তাই চুটকীর চেয়ে চুটীতে বেশ গুণপনাও প্রকাশ পায়। কিন্তু o, কিছু বড় জিনিস চাই। সেই আকাঙ্ক্ষাতেই এত কথা o বলিতেছি । বাঙ্গলায় রচনার বই বড় কম, নাই বলিলেও হয়। _ে নানা বিষয়ে ভাবিয়া চিন্তিয়া হেল্প সাহেবের মত বা এডিসন । সাহেবের মত রচনা লিখিতেছে—এ ত দেখা যায় না। ’ যাহা কিছু আছে এক কমলাকাস্তের দপ্তরে—অতুল অমূল্য ; আর ত দেখি না। আমাদের দেশের লোক এ পথটা কেন ছাড়িয়া দিতেছে, বুঝিতে পারি না। জীবনচরিতে দিন কতক বাঙ্গালীরা খুব পটুতা দেখাই৷ ছিল। কতকগুলি জীবনচরিত বাস্তবিক মহামূল্য র্য । হইয় দাড়াইয়াছিল। কিন্তু আরও চাই। এখনও জীবন চরিত ঠিক জীবনচরিত হয় নাই। ছ চারখানি জীবনচরিতে । দেখিতে পাই, কেবল জীবনের ঘটনাগুলি পর পর সাজান । আছে । কিন্তু তাহাকে জীবনচরিত বলে না। ঐ সাজান। ঘটনাগুলির কার্য্যকারপভাকগুলি সব দেখিতে হইবে। ১ম সংখ্যা ] !, গাজটি বেশ করিয়া বুঝিতে হইবে। ইতিহাস ভাল করিয়া জানা চাই। তবে ত ভাল জীবনচরিত হইবে । একজন মাহুষের জীবনচরিত দেখাইতে গিয়া তিনি যতদিন স্বাচিয় ছিলেন, ততদিন তাহাদ্বারা সমাজের, সাহিত্যের, ব্যবসায়ের, বাণিজ্যের কত পরিবর্তন হইয়াছে—সেগুলি সব দেখান চাই। এরূপ দেখাইবার চেষ্টা অনেকবার হইয়াছে, যাহার চেষ্টা করিয়াছেন তাহারা বিশেষ প্রশংসার যোগ্য ও ধন্যবাদের পাত্র। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বঙ্কিমবাবুর ভাল জীবনচরিত আজিও বাহির হইল না । যিনি ত্রিশ বংসর ধরিয়া বাঙ্গাল সাহিত্যের "মাদিত্যস্বরূপ" ছিলেন, তাহার একখানি ভাল জীবনচরিত আজিও বাহির হইল না। এ সম্বন্ধে একটা কথা বলা যাইতে পারে। মানুষ মরিলেই তাহার জীবনচরিত বাহির হওয়া, অনেক সময় ঠিক নয়। কারণ মাহুষ থাকিলেই তাহার সম্বন্ধে সুবিধা 'কুবিধা দুই থাকে। যাহারা স্ববিধা তাহারা শতমুখে তাহার স্বখ্যাতি করিবে, যাহার কুবিধা তাহারা শতমুখে নিন্দ করিবে—দোষ ছাড়া কিছুই দেখিতে পাইবে না। তাই মরিবার বিশ ত্রিশ বৎসর পরে জীবনচরিত লিখিলে ভাল হয়। কিন্তু তাহাতে আবার আর-এক দোষ হয় ৷ . অনেক ঘটনা লোকে ভূলিয়া যায়। জীবনচরিত সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয় বড়ই ভাগ্যবান, কারণ তাহার মৃত্যুর পরই তাহার ভাই তাহার এক প্রকাও জীবনচরিত লেখেন । তাহার পর অল্প দিনের মধ্যেই তাহার আরও দুইখানি জীবনচরিত বাহির হইয়াছিল। সুতরাং তাহার সম্বন্ধে ঘটনা ছাড় হইবার সম্ভাবনা কম। তবে পক্ষপাতশূন্ত হইয় তাহার জীবনচরিত লিখিবার সময় এখনও আসে নাই । কাব্যের দোষগুণ-পরীক্ষা এখনও আরম্ভ হয় নাই বলিলেই হয়। বঙ্কিমবাবু ও ভূদেববাবু এ বিষয়ে দু চারটি রচনা লিথিয়া গিয়াছেন। সে রচনা কোন কাব্যের কোন বিশেষ অংশ ধরিয়া। পুরা কাব্যখানি পড়িয়া, তাহ সম্পূর্ণরূপে হজম করিয়া, তাহার দোষ-গুণ দেখান এখনও হয় নাই। বঙ্কিমবাবুর নবেলের দোষগুণ-পরীক্ষা দুই তিনবার হইয়া গিয়াছে, তিনি বাচিয়া থাকিতেই দুই একবার হইয়৷ গিয়াছে। দুই একটা রচনা পড়িয়া তিনিও অত্যন্ত খুলী বাঙ্গলাভাষা ও সাহিত্যের গতি >>> - - ^ヘ? হইয়াছিলেন। মাইকেলের দোষগুণও অনেকে পরীক্ষা করিয়াছেন, কিন্তু সব কাব্য পড়িয়া মাইকেলের কবিতা বুঝাইবার চেষ্টা হয় নাই। এ বিষয়ে বাঙ্গলার একটা মন্ত । অভাব আছে। সে অভাব দূর করিবার ভার এক দীনেশ বাবুর ঘাড়ে চাপাইযা বসিয়া থাকিলে চলিবে না। এই একট। ব্যাপারে অনেকেই দেশের ভাল কাজ করিতে পারেন। কিন্তু নিৰ্ভয়ে দোষগুণ দুইই দেখাইয়া দেওয়া দরকার । বঙ্কিমবাবু “বঙ্গদর্শনে" একবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহার পর সে চেষ্টা আর দেখি নাই। এখন সংবাদপত্রে ও মাসিকপত্রে যেসব দোষগুণ-পরীক্ষা হয়, সেট যেন বিজ্ঞাপন দেওয়ার মত। “ওগো অমুক এই বই লিথিয়াছেন, তোমরা কেন’ ”—এই যেন সে বিচারের মানে। অনেক মাসিকপত্র ও সংবাদপত্রের সম্পাদকেরা বলেন, “আমাদের পড়িবার সময় নাই। গ্রন্থকারেরা আপনার গ্রন্থের দোষগুণ দেখাইয়া দিলে আমরা ছাপাইতে পারি।" এ কথাটা যে নিতান্ত মিথ্যা তাহা নহে, কিন্তু এরূপ দোষগুণ-বিচার আমরা চাহি না । আসামী জজ হইয়া বিচার করিবে, এটা বোধ হয় কেহই চাহিবেন না । অনেকের সংস্কার বাঙ্গালা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা। ঐযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় সংস্কৃতকে বাঙ্গলা ভাষার ঠানদিদি বলিয়াছেন। আমি কিন্তু সংস্কৃতকে বাঙ্গলার অতি-অতি-অতি-অতি-অতি-অতিবৃদ্ধপ্রপিতামহী বলি। পাণিনির সময় সংস্কৃতকে ভাষা বলিত অর্থাং পাণিনি যে সময় ব্যাকরণ লেখেন, তখন তাহার দেশে লোকে সংস্কতে কথাবার্তা কহিত । তাহার সময় আর-এক ভাষা ছিল, তাহার নাম “ছন্দস”—অর্থাং বেদের ভাষা। বেদের ভাষাটা তখন পুরাণ; প্রায় উঠিয়া গিয়াছে। সংস্কৃত ভাষা চলিতেছে। পাণিনি কতদিনের লোক তাহা জানি না, তবে খ্ৰীষ্টপূৰ্ব্ব ষষ্ঠ সপ্তম শতকের বোধ হয়। তাহার অল্প দিন পর হইতেই ভাষা ভাঙ্গিতে আরম্ভ করে। বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পরই তাহার চুলার ছাই কুড়াইয়া এক পাথরের পাত্রে রাখা হয়। তাহার গায়ে যে ভাষা লিখিত আছে, সে ভাষা সংস্কৃত নয় ; তাহার সকল শব্দই সংস্কৃত হইতে আসা, কিন্তু সে ভাষা সংস্কৃত হইতে অনেক তফাৎ হইয়া পড়িয়াছে। তাহার পরই অশোকের শিলালেখের ভাষা।