রক্তকরবী ঐ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ আপনাদের ‘বারোয়ারী সভায় আমার “নন্দিনী"র পালা অভিনয়। প্রায় কখনো ডাক পড়ে না, এবারে কৗতুহল হয়েছে। ভয় হচ্ছে, পালা সাঙ্গ হ’লে ভিখ মিলবে না, কুত্তা লেলিয়ে দেবেন । তারা পালাটাকে ছিড়ে কুটিকুটি করবার চেষ্টা করবে। এক ভরসা, কোথাও দস্তস্ফুট করতে পারবে না। আপুনার প্রবীণ। চশমা বাগিয়ে পালাটার ভিতরথেকে একটা গুঢ় অর্থ খুঁটিয়ে বের-করবার চেষ্টা করবেন। আমার নিবেদন, যেটা গৃঢ় তাকে প্রকাশ করলেই তার সার্থকতা চ’লে যায়। হৃৎপিণ্ডট। পাজরের আড়ালে থেকেই কাজ করে । তাকে বের ক’রে তার কাব্যপ্রণালী তদারক করতে গেলে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। দশমুণ্ড বিশহাতওয়াল রাবণের স্বর্ণলঙ্কায় সামান্ত একটা বন্ত বানর ল্যাঞ্জে ক’রে আগুন লাগায় এই কাহিনীটি যদি কবিগুরু আজ আপনাদের এই সভায় উপস্থিত করতেন তা হলে তার গুঢ় অর্থ নিয়ে আপনাদের চণ্ডীমণ্ডপে একটা কলরব উঠ ত । সন্দেহ করতেন কোনো একটা স্বপ্রতিষ্ঠিত বিধি-ব্যবস্থাকে বুঝি বিদ্রুপ করা হচ্ছে। অথচ শত শত বছর ধ’রে স্বভাব-সন্দিগ্ধ লোকেরাও রামায়ণের প্রকাশ্যে যে-রস আছে তাই ভোগ করে এলেন–গোপনে যে অর্থ আছে তার কুটি ধ’রে টানাটানি করলেন না । আমার পালায় একটি রাজা আছে। আধুনিক যুগে তার একটার বেশি মুণ্ড ও দুটোর বেশি হাত দিতে সাহস হ’ল না। আদিকবির মতো ভরসা থাকুলে দিতেম। বৈজ্ঞানিক শক্তিতে মামুষের হাত পা মুণ্ড অদৃপ্তভাবে বেড়ে গেছে । আমার পালার রাজা যে সেই শক্তিবাহুল্যের যোগেই গ্রহণ করেন, গ্রাস করেন, নাটকে এমন আভাস আছে । ক্রেতাযুগের বহুসংগ্রহী বহু গ্রাসী রাবণ বিদ্যুৎবজ্ৰধারী দেবতাদের আপন প্রাসাদ-দ্বারে শুম্বলিত ক’রে তাদের দ্বারা কাজ আদায় করত। তার প্রতাপ চিরদিনই অক্ষুণ্ণ থাকৃতে পাবৃত। কিন্তু তার দেবদ্রোহী সমৃদ্ধির মাঝখানে হঠাৎ একটি মানববন্ত এসে দাড়ালেন, অমুনি -o---------- .* * কবির অভিভাষণ - ধৰ্ম্ম জেগে উঠলেন। মূঢ় নিরস্ত্র বানরকে দিয়ে তিনি রাক্ষসকে পরাস্ত করলেন। আমার নাটকে ঠিক এমনটি ঘটেনি কিন্তু এর মধ্যেও মানবকল্পার আবির্ভাব আছে । তা ছাড়া কলিযুগের রাক্ষসের সঙ্গে কলিযুগের বানরের যুদ্ধ ঘটবে এমনও একটা স্বচনা আছে । - আদি কবির সাতকাণ্ডে স্থানাভাব ছিল না এই কারণে লঙ্কাপুরীতে তিনি রাবণ ও বিভীষণকে স্বতন্ত্র স্থান দিয়েছিলেন । কিন্তু আভাস দিয়েছিলেন যে তারা একই, তার সহোদর ভাই । একই নীড়ে পাপ ও সেই পাপের মৃত্যুবাণ লালিত হয়েছে। আমার স্বল্পায়ুতন নাটকে রাবণের বর্তমান প্রতিনিধিটি একদেহেই রাবণ-ও বিভীষণ ; সে আপনাকেই আপনি পরাস্ত করে। বাল্মীকির রামায়ণকে ভক্ত পাঠকের সত্যমূলক ব’লে স্বীকার করেন । আমার পালাটিকে যারা শ্রদ্ধা ক’রে শুনবেন তার জানবেন এটিও সত্যমূলক । ঐতিহাসিকের উপরে প্রমাণের ভরে দিলে ঠকবেন । এইটুকু বললেই যথেষ্ট হ’বে যে, কবির জ্ঞান-বিশ্বাস-মতে এটি সত্য । ঘটনা-স্থানটির প্রকৃত নাম নিয়ে ভৌগোলিকদের কাছে মভের ঐক্য প্রত্যাশা করা মিছে । স্বর্ণলঙ্ক-যে সিংহলে ত নিয়েও আঞ্জ কত কথাই উঠেছে। বস্তুত পৃথিবীর নানা স্থানে নানা স্তরেই স্বর্ণলঙ্কার চিহ্ন পাওয়া যায়। কবিগুরু যে সেই অনির্দিষ্ট অথচ স্থপরিনিৰ্দ্দিষ্ট স্বর্ণলঙ্কার সংবাদ পেয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। কারণ সে স্বৰ্ণলঙ্কা যদি খনিজ সোনাতেই বিশেষ একটা স্থানে প্রতিষ্ঠিত থাকৃত তা হ’লে ল্যাঞ্জের আগুনে ভস্ম না इ'एग्न আরো উজ্জল হ’য়ে উঠত। Q স্বৰ্ণলঙ্কার মতোই আমার পালার ঘটনা-স্থানের একটি ডাক নাম আছে । তাকে কবি যক্ষপুরী ব’লে জানে। তার কারণ এ নয় যে সেখানে পৌরাণিক কুবেরের স্বর্ণসিংহাসন । ধক্ষের ধন মাটির নীচে পোত আছে । এখানকার রাজা পাতালে স্বরঙ্গ-খোদাই ক’রে সেই ধন হরণে নিযুক্ত। তাই আদর ক'রে এই পুরীকে সমঝদার লোকেরা যক্ষপুরী বলে। লক্ষ্মীপুরী কেন বলে না ?
পাতা:প্রবাসী (পঞ্চবিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩৯
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।