পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কীৰ্ত্তিক গেল। তার নিদারুণ এই যন্ত্রণার মধ্যে এমন একজন লোকের কথা সে ভাবতে পারে না যার কাছে হৃদয়ের ভার মোচন করে এই আত্মঘাতী চিন্তা থেকে সে নিস্কৃতি পায়। মালতী তাকে ভালবাসে বটে, কিন্তু তারই স্বামীর বিরুদ্ধে তার কাছে সে নালিশ জানাবে কোন লজ্জায় ! তা ছাড়া তাদের নিরাময় নিশ্চিস্ত জীবনযাত্রার মধ্যে জেনে শুনে সে এই সৰ্ব্বনাশের বীজ বপন করবে কেমন করে । তবে সে কি করবে ? এই নূতন সৰ্ব্বনাশ থেকে মালতীকে এবং নিজেকে বঁাচাবে কেমন করে ? দিনে রাত্রে তার স্বস্তি অস্তহিত হয়ে তাকে পীড়িত করতে লাগল। কয়েক দিন খাওয়াদাওয়া একরকম সে পরিত্যাগ করলে। শুধু মুখে কিছু রোচে না বলে নয় ; নিজের দুরপনেয় দুর্ভাগ্যকে নিজ্জিত করবার অন্য কোনও সহজ উপায় চিন্তা ক’রে উঠতে পারে নি বলে। আত্মহত্য করার সাহস বা উদ্যম তার ছিল না কিন্তু আত্মনিগ্রহের চেষ্টাকে তার অন্যায় অকারণ দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে সে যে এক প্রকার আত্মবিনাশের আস্বাদন পায় তার থেকে নিজেকে সংযত করতে সে চায় না। এমনি ক'রে করে একদা সত্যই সে পীড়িত হয়ে পড়ল । নদারুণ মাথার যন্ত্রণা। যন্ত্রণায় যেন সে পাগল হয়ে যাবে ক্রমে সে-যন্ত্রণা এত বেড়ে উঠল ; এমন ক'রে তার চেতনাকে আচ্ছন্ন ক'রে আনতে লাগল যে তার মনে হ’ল এর থেকে তার বুঝি আর নিষ্কৃতি হবে না; এবার সে বঁাচবে না ; এবং এ কয়দিন যে-মৃত্যুকে তার বরণীয় বলে মনে হয়েছিল তারই অতিস্কে তার সমস্ত মন যে এমন অভিভূত হয়ে পড়তে পরে এর রহস্য কে নির্ণয় করবে ? তার স্বামীর মুখ সে কোন দিন আর দেখতে পাবে না এই চিন্তায় তার হারানো স্বামীর জন্যে অনেক দিন পরে তার নিরুদ্ধ অশ্রীরাশি উদ্বেল হ’য়ে উঠল। ঘোর নিরাশার অন্ধকারের অন্তরালে কেমন ক’রে যে তার স্বামীকে ফিরে দেখবার অাশা বেঁচে ছিল, ভাবলে অবাক হতে হয়। এই নিঃসহায় অবস্থায় তার মনে নিখিলনাথের কথা জেগে উঠল। তার মনে কেমন একটা সন্দেহ হ’ল যে নন্দ সম্ভবত অন্বেষণের চেষ্টা থেকে ইচ্ছা ক’রেই বিরত থেকেছে; এবং নিখিলনাথকে জানালে এতদিন একটা উপায় হতেও পারত। এতদিন নিখিলনাথকে জানায় নি বলে তার অনুশোচনা হ’ল এবং নিখিলনাথকে কোনও স্বযোগে সমস্ত কথা খুলে বলবে বলে মনে মনে সংকল্প করলে । Vog সীমা তার কাজকৰ্ম্ম সমাধা করে রোগীর রাত্রের পথ্য প্তিত ক'রে নিয়ে হলঘরে ফিরে এল। তখন নিতান্ত ন্তি হয়েই বোধ হয় সত্যবান চুপ করেছে—এবং খোলা ক্রিবেণী $OS দরজার মুক্তপথে বাইরের ঘনকৃষ্ণ নিরেট অন্ধকারের উপর তার নিনিমেষ দৃষ্টি রেখে রোগীর পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে নিখিলনাথ। মনে হয় যেন তার তীক্ষ স্থঙ্কাঁগ্র দৃষ্টির নিয়ত একাগ্র চেষ্টায় সে ঐ অন্ধকার কালো পাথরটার মধ্যে ছোট একটু ছিদ্রপথ স্বষ্টি করতে চায়, আনন্দময় অনন্ত আলোকের একটি মাত্র রশ্মিরেখাও যার অবকাশে তার দিশাহার চিত্তের মধ্যে মুক্তি লাভ করতে পারে। সীমা এসে পথ্যটি রোগীর মাথার কাছে সযত্নে ঢেকে রাখল। পিপড়ের ভয়ে একটা কেরোসিন তেলের দ্যাভ দিয়ে বিছানার চারিপাশ পরিষ্কার করে মুছে নিলে। টুকিটাকি সব গোছগাছ ক’রে রেখে সে পাশের ঘরে চলে গেল । নিখিলনাথ বসে মনে মনে এই মেয়েটির নিরবচ্ছিন্ন কৰ্ম্মের বিরামহীন ধারার কথা আলোচনা করছিল। ক্লাস্তি যেন এই মেয়েটির অপরিচিত অথচ কোনো আতিশয্য বা সঙ্কোচ এর কোনো কাজের সৌষ্ঠবকে কুষ্ঠিত করে না। ও যেন শাণিত তীরের মত—তেমনি তীয়, তেমনি ক্ষিপ্র, তেম্নি সঙ্গীহীন, তেম্নি লক্ষ্যপথে অমোঘ গতি বোধ হয় তেমুনি ভয়ঙ্কর। কোন মন্ত্রে সত্যবানের হাতের জ্যামুক্ত এই অগ্নিবাণকে সম্বরণ ক’রে জীবনের অমৃতরসধারায় শাস্তির পথ সে দেখাবে ? বিচ্ছুরিত বিদ্যুৎবহিকে বিগলিত ক’রে তাকে সে ধারাবর্ষণে পরিণত করবে কোন মারুৎমন্ধে ? সত্যবানের উপর অসহায় অভিমানে তার মন বিদ্রোহ করে উঠতে চাইলে । সীমাকে এমন একান্ত বিপদের মধ্যে নিঃসহায় ফেলে রেখে নিশ্চিন্ত মৃত্যুর মধ্যে সত্যবানের এই মুক্তিকে তার স্বার্থপরের মত বোধ হতে লাগল। সীমার প্রতি অপরিসীম করুণায় তার হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল এবং সীমাকে এই সৰ্ব্বনাশ থেকে, এই মৃত্যুর পথ থেকে, এই মহত্বের উন্মত্ততা থেকে উদ্ধার করবার জন্যে মনে মনে বারম্বার সে প্রতিজ্ঞাবাক্য উচ্চারণ করতে লাগল। সে এই প্রতিজ্ঞার স্বত্রে, তার নিজেরই গোপন অবগাঢ় মনের বাসনার প্রেরণায়, নিজের অগোচরে সত্যবানেরই ইচ্ছ। যে প্রতিপালন করতে চলেছে একথা তার মনে রইল না। এমন সময় একটা পুটলী-হাতে পাশের ঘর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। ময়লা কাপড় ইটুের উপর গাছকোমর করে পর, ফতুয়ার উপর একটা গামছা জড়ানো, মাথায় একটা টোকা । সেই স্বল্প আলোকে নিখিলনাথ মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখল। কলেজে-পড়া শকুন্তলার বর্ণনা তার মনে পড়ে গেল “ইয়মধিকমনোজ্ঞা বন্ধলেনাপি তন্ত্ৰী” এবং অকারণেই সে অন্ধকারে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। সীমা মাথার টোকাটা খুলে ফেলে কাছে এগিয়ে এসে মৃদ্ধ স্বরে বললে, “চলুন আপনাকে পথ দেখিয়ে দিয়ে আসি " তার মুখে অনাবশ্যক লজ্জা বা অস্বাভাবিকতার