পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SOR প্রবাসী SN98NE আভাসমাত্র ছিল না। এই অৰ্ধপরিচিত পুরুষটিকে যে স্ত্রীজনোচিত কোনরূপ সঙ্কোচের ব্যঞ্জনায় খাতির করা আবগুক, তার নিতান্ত ভাববিহীন মুখে তার কোনো চিহ্নমাত্র নাই। ব্যাপারটা সামান্তই কিন্তু নিখিলনাথের পৌরুষ আজ দ্বিতীয়বার যেন লুব্ধ বালকের মত তিরস্কার লাভ করলে । অকারণেই সে নড়েচড়ে সংযত হয়ে বসল। ঠিক সেই সময় দারুণ যন্ত্রণায় সত্যবানের শরীরটা চক্রদলিত সাপের মত মোচড় দিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠল। দুই জনই এক সঙ্গে তার উপর ঝুকে পড়ল। অসহ যন্ত্রণায় সত্যবানের চোখ সেই প্রায়ান্ধকার শূন্তকে যেন ফুড়ে ছুটে বেরতে চায়,—দুটো জলন্ত গুলি যেন, বন্দুকের নলের মুখে এসে আটকে গেছে। নিখিলনাথ তার ডাক্তারী জীবনের বহু মৃত্যুদৃশ্বের অভিজ্ঞতার মধ্যেও যন্ত্রণার এমন বীভৎস এমন প্রকট মূৰ্ত্তি কখনও দেখে নি। কি করবে কিছুই দিশা না পেয়ে ক্ষিপ্ৰ হাতে তাঁর পকেট-কেস বার করে আবার একটা ইনজেকশনের আয়োজন করতে লেগে গেল । নিখিল কম্পিত হাতে সব ঠিকঠাক ক’রে রোগীর দিকে যখন মন দিলে তখন রোগীর দেহু স্থির হয়েছে। সীমা নিঃশব্দে স্তন্ধ হয়ে বসে আছে অসহায় ছু-খান হাত সত্যবানের গায়ে মাথায় অকারণে রেখে। তার সমস্ত ভঙ্গীটির মধ্যে স্নেহের অভিব্যক্তি যেমন পরিস্ফুট নিজেকে অবিচলিত রাখার ভাব তেমনি স্বম্পষ্ট। রোগীর শান্ত মুখের দিকে চেয়ে নিখিলের বুকটা ধড়াস করে উঠল। তাড়াতাড়ি সে হাতটা নিয়ে তার প্রাণের স্পন্দন অনুভব করবার চেষ্টা করলে— ষ্টেথসকোপট বার করে বারদ্বার মূঢ় আশায় পরীক্ষা করতে লাগল। হায় নেই, নেই, কোথাও সেই দীপ্ত শিখার ক্ষীণতম রশ্মিরেখাও চোখে পড়ে না। ডাক্তার হ’লেও সত্যবানের এই বীভৎস মৃত্যু সে যেন কিছুতেই মনে মনে স্বীকার করে নিতে পারছে না। কিছুতেই মনে বিশ্বাস ধেন হয় না যে অতবড় একটা দাবানল দপ, ক’রে নিবে গেছে। চীৎকার ক'রে তার একবার ডাকৃতে ইচ্ছে হচ্ছে “সত্যদা”—যদি এই ঘনান্ধকার নিশীথের দূরতম দিগন্ত থেকেও একটা উত্তর পায়। তৰু অসহায় বেদনায় চুপ করেই সে বসে রইল। সীমার দিকে চাইতে তার সাহস হয় না। কেমন ক’রে সে ঐ মেয়েটিকে জানাবে যে, যে-মহাপ্রাণের দীপ্তিকে সে সৌদামিনীর মত বুকে ক’রে দেশ থেকে দেশান্তরে ফিরেছে— সে আজ স্তিমিত । এখন তাঁর বর্ষণের পালা স্বরু হবার দিন এসেছে ! কতক্ষণ সে চুপ করে অন্ধকারের দিকে চেয়ে বসেছিল তার মনে নেই। হঠাৎ সীমার হাতের স্পর্শে সে চমকে ডাকলে “সত্যঙ্গ” অতর্কিতে মনে হয়েছিল বুঝি সত্যবানেরই হাত। সীমা তৎক্ষণাৎ তার মুখে হাত চাপা দিয়ে তাকে নিঃশব্দ থাকতে ইঙ্গিত করলে। দুরে বাইরে কোথায় একটা আলেয় দপ, ক’রে জলে উঠে আবার নিবে গেল। মুহূর্ভের মধ্যে উঠে গিয়ে সীমা ঘরের বাতিটা নিবিয়ে দিলে । অতি অরক্ষণ, দু-মিনিটও না-হতে পারে,—তৰু মৃত সত্যবানের পাশে বসে তার মনে হ’তে লাগল সময় যেন নিজের আবর্তে একই জায়গায় ক্রমাগত পাক খাচ্ছে ; কিছুতে আর এগোতে পারছে না। বিস্ময়ে এমন কি ভয়ে সে স্তন্ধ হয়ে রইল। এবং এক সময়, কল্পনাতেই বোধ হয়, কিসের একটা শব্দ অনুভব ক’রে সে মৃতদেহের পাশ থেকে নিজের অজ্ঞাতে সরে বসল। ষে-সত্যবান এতক্ষণ তার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয় ছিল, ইতিমধ্যেই তার মনের অগোচরে সে অপরিচিত হয়ে উঠেছে। অল্পক্ষণ পরেই সীমা এসে তাকে বাইরে নিয়ে এল এবং শব্দমাত্র না ক’রে অন্ধকার বনের দিকে অগ্রসর হ’ল । নিখিল আশ্চৰ্য্য হয়ে ভাবলে “সীমার কাছে এই মৃত্যুসংবাদ অপরিজ্ঞাত আছে ” সে সীমাকে থামিয়ে বললে “এখন যাব ন সত্যদাকে ছেড়ে ।” সীমা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললে “বিপদ আছে—একটুও দেরী করা চলবে না ” বলে তার হাত ধরে দৃঢ়পদে বনপথে প্রবেশ করলে। এই মেয়েটির আদেশ যে অগ্রাহ করা চলবে না তা মনে মনে অনুভব করে নিখিল অগত্যা বিনা বাক্যব্যয়ে তার অনুসরণ করতে লাগল। তার কেবলই মনে হ’তে লাগল “সত্যদা একলা পড়ে রইল। মৃতদেহের প্রতি— সত্যবানের মত মহাত্মার প্রতি—এ যে অসম্মান ৷ ” একটা অপরিণত মেয়ের অঙ্গুলিপরিচালনায় সে তার কৰ্ত্তব্য পরিত্যাগ ক’রে পলায়ন করেছে এই কথা চিন্ত| ক’রে সে যেমন বিস্মিত হ’ল. নিজের প্রতি বিরক্তও হ’ল ততোধিক। সে বারস্বার নিজেকে সংহত ক’রে নিয়ে এই পলায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাইল, কিন্তু ফলে সে কল্পনায় নিজের মনে সীমার সঙ্গে অকারণে তর্কবিতর্ক করতে করতে তারই কোমল হন্তের অব্যাহত আকর্ষণে অগ্রসর হয়ে চলল অন্ধকার বনতলের নানা চক্রপথে । কতক্ষণ তারা এমনি ক'রে কত পথ চলেছে নিখিলের তা খেয়াল নেই। এক ঘণ্টাও হতে পারে—কিন্তু তার যেন মনে হয় অল্পক্ষণই হবে—-চলতে চলতে তার বন থেকে বেরিয়ে একটা কাচা রাস্তায় এসে পড়ল। নিঃশ্বাস যেন এতক্ষণ অবরুদ্ধ ছিল। অকস্মাৎ মুক্ত বাতাসে এসে সহজে শ্বাস গ্রহণ করতে পেরে সে নিজের মধ্যে নিজেকে অনুভব করলে। রাস্তা উঠে সে তার এতক্ষণের অমৃতপ্ত চিন্তাকে মুক্তিদান করলে। বললে “সত্যদাকে এমনি ক’রে ফেলে যেতে আমার মন চাইছে না। চল ফিরে যাই ।” সীমা নিখিলের হাতটা মুক্ত করে দিয়ে শুষ্ক কঠিন স্বরে বললে, “ফিরে যাবেন ? কোথায় যাবেন ফিরে ? অার এক