পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SNE8 বলিলাম—ন, থাক। আমি বেশ হেঁটেই যাব। হাসিয়া মোড়ল বলিল—বড় হয়েছেন কিনা, নজা। নোকের কাধে চেপে যেতে বড় নজা করে, নয় গা ? বলিয়া হে হো করিয়া হাসিতে লাগিল। এবারও মোড়ল মুগ, কলাই, লাউয়ের বোঝা নৌকায় চাপাইয়া দিয়া গেল। প্রণামীর টাকা দিল, কাপড় দিল এবং হাসিমুখে বলিল—ম-ঠাকরোণ গে, এবার যখন আসবা তখন উই বেলেডাঙায় গিয়ে উঠিছি দেখব । সব্বনাশী কি মোদের থল বাধতে দেবেন গা ! বলিয়া গজার পানে চাহিয়া রহিল। মনে হইল, ওই কঙ্কালসার কর্কশ চেহারার লোকটি কাদিতেছে। আরও কয়েক বছর পরে যেবার মগুল-বাড়ী যাই সে-বার বেলেডাঙায় গিয়া উঠিয়াছিলাম। বেলেডাঙায়ও গঙ্গা মণ্ডলবাড়ীর নিমে পাড় ভাঙিতেছিল। কিন্তু গঙ্গাকে ভয় করিবার উহাদের অবশিষ্ট কিছু ছিল না। ছোট একখানি বাগান— অৰ্দ্ধেকটা তাহার গঙ্গাগর্তে—বাকি অৰ্দ্ধেকটায় মোড়লদের বাসগৃহ । বাসগৃহ ত বাসগৃহ ! মাত্র ছোট দুখানি ঘরের কোলে ফালি একটু দাওয়া । সঙ্কীর্ণ উঠান—মরাইয়ের চিহ্ন নাই, গরু ছাগলের ডাক শোনা যায় নী—এমন কি ছেলেমেয়ের কোলাহলও শুনিলাম না । বিধবা বড়বউয়ের কোলে পাচ বছরের এক রুগ্ন ছেলে মগুল-বংশের শেষ আশা-প্রদীপ ঝড় এই বংশের উপর দিয়া ভাল ভাবেই বহিয়া গিয়াছে—মহীরুহ উৎপাটিত হইয়াছে, ছিয়শাখা অৰ্দ্ধমৃত এই শিশুতরুমাত্র খুঁকিতেছে! বৃদ্ধা দিদিমার পায়ে পড়িয়া মোড়ল-বউ কত দুঃখের কান্নাই কাদিল । সে-সব বিলুপ্ত গৌরবের করুণ কাহিনী এখানে পুনরুক্তি করিয়া কি-ই বা লাভ? সংসারে রোগ আছে, মৃত্যু আছে, আরও অনেক বিপদ আছে। মগুল-পরিবারে একে একে সে-সবের পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে। পরীক্ষার শেষ এখনও হয় নাই,—এই রুগ্ন শিশু ও বিধবা রক্ষয়িত্রী তার সাক্ষ্য । গঙ্গাগর্তে উচ্চ পাড় ভাঙিয়া পড়িয়া যেদিন মণ্ডলদের ভিটাটুকু নিশ্চিহ্ন করিয়া দিবে সেদিন অতীত ইতিহাসের পৃষ্ঠা উন্টাইয়া কেহ আর নয়ন অশ্রুসিক্ত করিবে না। সন্ধ্যা সমাগত দেখিয়া মোড়ল-বউ ছেলেকে বিছানায় প্রবাসী দেখা গেল। শীর্ণকায় মগুল-বউয়ের SNම්GNළං শোয়াইয়া দিয়া তুলসীতলায় প্রদীপ জালিয় প্রণাম করিল। প্রণাম আর শেষ হয় না । মগুল-বংশের স্থায়িত্ব ও এই সন্তানের আয়ুপ্রার্থনা করিয়া মণ্ডল-বউ তুলসীতলায় মাথা কুটিতে লাগিল। বহুক্ষণ প্রার্থনার পর বউ সেই প্রদীপ তুলিয়া লইয়া আমবাগানের মধ্য দিয়া গঙ্গার কুলে গিয় দাড়াইল। প্রদীপ উচু করিয়া বউ দেবীকে সকাতর মিনতি জানাইতে লাগিল—হেই মা, মুখ তুলে চা। ফিরে যা ফিরে যা। ভিটেটুকুতে আর নোভ করিস নে মা, মুখ তুলে চা। বাড়ী ফিরিয়া বউ শাখে বার-কতক ফু দিল । সন্ধ্যা দেখানো শেষ করিয়া দিদিমার কাছে আসিয়া বসিল ও রুদ্ধ কণ্ঠে কহিল—ম গো, নিত্যি দেবতাকে বলি, ভিটেটুকু বজায় রাখ–বংশধরকে বাচা। ই মা, এত কি মহাপাতকী মুই যে মোদের কত শোনবেন না ! দিদিমা বলিলেন—গুনবেন বইকি মোড়ল-বউ। পরের দিন সন্ধ্যাকালে খেয়া পার হইতেছিলাম। দুটি ছোট পুটুলি কোলের উপর রাখিয়া মণ্ডলদের ভিটার পানে চাহিয়া ছিলাম। কাঠাখানেক ( আড়াই সের ) মুগ ও ছোলা আধ কাঠা ;–দিদিমাও লইবেন না—মোড়ল-বউও ছাড়িবেন না—অনেক কান্নাকাটি অনুনয়-বিনয়ে দুটি পুটুলি ও খেয়া-পারের পয়সা লইতে হইয়াছিল। নৌকার উপর বসিয়া অনেকে অনেক কথা বলিতেছিল। এমন সময় দূরে আমবাগানের মধ্যে প্রদীপের আলে৷ মূৰ্ত্তি চোখে পড়িল ন—প্রদীপটি বারকয়েক আন্দোলিত হইল মাত্র। নদীদেবতার কাছে নিত্যকার সান্ধ্য প্রার্থনা বহিয়া যে দীপশিখ অাম্র-বনাভ্যন্তরে র্কাপিয়া কঁাপিয়া উঠিতেছে তাহার অন্তরালে তপঃক্লিষ্ট মঙ্গলপ্রাধিনী বন্ধটিকে মনে পড়িল । দীপের আলোয়—যিনি নদীর প্রসন্নত মাগিয়া বাস্তুদেবতার স্থিতি কামনা করিতেছেন এবং শম্বের মঙ্গলধ্বনি তুলিয়৷ উদ্ধৰ্গ দেবতার চরণে বংশধরের আয়ু ভিক্ষা করিতেছেন। কে এক জন সেই দিকে চাহিয়া বলিল—বউটার পূজো ম। গঙ্গা নিয়েছেন। দেখ নি, এ-ধারে চড়া পড়তে আরম্ভ হয়েছে। দেবী প্রদীপের আরতি গ্রহণ করিয়াছেন, দেবতা কি মঙ্গলশন্থের ডাক শুনিতে পাইবেন ?