পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের স্বষ্টিতে নারী পুরাতনী। নরসমাজে নারীশক্তিকে বলা যেতে পারে আদ্যাশক্তি। এই সেই শক্তি যা জীবলোকে প্রাণকে বহন করে, প্রাণকে পোষণ করে । পৃথিবীকে জীবের বাসযোগ্য করবার জন্যে অনেক যুগ গেছে ঢালাই পেটাই করা মিস্ত্রীর কাজে। সেটা আধখানা শেষ হ’তে-না-হতেই প্রকৃতি স্বরু করলেন জীবস্বষ্টি, পৃথিবীতে এল বেদনা। প্রাণসাধনার সেই আদিম বেদনা প্রকৃতি দিয়েছেন নারীর রক্তে, নারীর হৃদয়ে। জীবপালনের সমস্ত প্রবুদ্ভিজাল প্রবল ক’রে জড়িত করেছেন নারীর দেহ মনের তন্তুতে তন্তুতে। এই প্রবৃত্তি স্বভাবতই চিত্তবৃত্তির চেয়ে হৃদয়বৃত্তিতেই স্থান পেয়েছে গভীর ও প্রশস্ত ভাবে । এই সেই প্রবৃত্তি, নারীর মধ্যে যা বন্ধনজাল গাথছে, নিজেকে ও অন্যকে ধরে রাখবার জন্তে প্রেমে স্নেহে সকরুণ ধৈৰ্য্যে। মানব-সংসারকে গড়ে তোলবার বেঁধে রাখবার এই আদিম বাধুনি। এ সেই সংসার যা সকল সমাজের সকল সভ্যতার মূলভিত্তি। সংসারের এই গোড়াকার বঁাধন না থাকলে মাতুষ ছড়িয়ে পড়ত আকারপ্রকার-হীন বাম্পের মত ; সংহত হয়ে কোথাও মিলনকেন্দ্র স্থাপন করতে পারত না । সমাজবন্ধনের এই প্রথম কাজটি মেয়েদের ৷ প্রকৃতির সমস্ত হষ্টিপ্রক্রিয় গভীর গোপন, তার স্বতঃপ্রবর্তনা দ্বিধাবিহীন । সেই আদি প্রাণের সহজ প্ৰবৰ্ত্তন! নারীর স্বভাবের মধ্যে। সেই জন্য নারীর স্বভাবকে মানুষ রহস্যময় আখ্যা দিয়েছে । তাই অনেক সময়ে অকস্মাৎ নারীর জীবনে যে সংবেগের উচ্ছ্বাস দেখতে পাওয়া যায় তা তর্কের অতীত—তা প্রয়োজন অনুসারে বিধিপূৰ্ব্বক খনন করা জলাশয়ের মত নয়, তা উৎসের মত, যার কারণ আপন অহৈতুক রহস্তে নিহিত। প্রেমের রহস্য, স্নেহের রহস্য অতি প্রাচীন ; এবং দুর্গম । সে আপন সার্থকতার জন্তে তর্কের অপেক্ষ রাখে না । উঠতে উঠতে তাকে টানে যেখানে তার সমস্যা সেপালে তার দ্রুত সমাধান চাই । তাই গুহে নারী যেমনই প্রবেশ করেছে, কোথা থেকে অবতীর্ণ হ’ল গৃহিণী, শিশু যেমনই কোলে এল, মা তখনই প্রস্তুত । জীবরাজ্যে পরিণত বুদ্ধি এসেছে অনেক পরে। সে আপন জায়গা খুঁজে পায় সন্ধান করে, যুদ্ধ করে । দ্বিধ মিটিয়ে চলতে তার সময় যায়। এই দ্বিধার সঙ্গে কঠিন দ্বন্দ্বেই সে সবলতা ও সফলতা লাভ করে । এই দ্বিধা-তরঙ্গের ওঠা-পড়ায় শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে যায়, সাংঘাতিক ভ্ৰম জমে উঠে বার বার মাযের ইতিহাসকে দেয় পৰ্য্যস্ত করে । পুরুষের স্বষ্টি বিনাশের মধ্যে তলিয়ে যায়, নুতন করে বাধতে হয় তার কীৰ্ত্তির ভূমিকা । পালটিয়ে পালটিয়ে পরীক্ষায় পুরুষের কৰ্ম্ম কেবলই দেহ পরিবর্তন করে । অভিজ্ঞতার এই নিত্য পরিক্রমণে যদি তাকে অগ্রসর করে তবে সে বেঁচে যায়, যদি ক্রটি-সংশোধনের অবকাশ না পায় তবে জীবন-বাহনের ফাটল বড় হয়ে বিলুপ্তির কবলের মধ্যে । পুরুষের রচিত সভ্যতার আদিকাল থেকে এই রকম ভাঙগড়া চলছে। ইতিমধ্যে নারীর মধ্যে প্রেয়সী, নারীর মধ্যে জননী প্রকৃতির দৌত্যে স্থির প্রতিষ্ঠিত হয়ে আপন কাজ ক'রে চলেছে । এবং প্রবল আবেগের সংঘর্ষে আপন সংসারের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে অগ্নিকাণ্ড করেও আসছে । সেই প্রলয়াবেগ যেন বিশ্বপ্রকৃতির প্রলয়লীলারই মত, ঝড়ের মত, দাবদাহের মত, আকস্মিক, আত্মঘাতী । পুরুষ তার আপন জগতে বারে বারে নূতন আগন্তুক। আজ পর্যন্ত কতবার সে গড়ে তুলেছে আপন বিধি বিধান। বিধাতা তাকে তার জীবনের পথ বাধিয়ে দেন নি ; কত দেশে কত কালে তাকে আপন পথ বানিয়ে নিতে হ’ল । এক কালের পথ বিপথ হয়ে উঠল আর এক কালে, উলটিয়ে গেল তার ইতিহাস। করলে সে অস্তধর্ণন । নব নব সভ্যতার উলটপালটের ভিতর দিয়ে নারীর