পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Tআগ্রহায়ণ অত্যন্ত কঠিন কাৰ্য্য। প্রথমতঃ যিনি কথকতা করিবেন, তাহার সংস্কৃত ব্যাকরণে এবং নানা শাস্ত্রে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য থাকা প্রয়োজন। "কথা" কহিবার সময় মধ্যে মধ্যে র্তাহাকে আলোচ্য শাস্ত্র ব্যতীত উপনিষদ, গীত, চণ্ডী প্রভৃতি বিবিধ ধৰ্ম্মপুস্তকের শ্লোক উদ্ভূত করিয়া তাহার ব্যাখ্যা করিতে হয়। ঐ সকল ব্যাখ্যা যাহাতে নিতুল হয়, তৎপ্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা চাই। কারণ শ্রোতাদের মধ্যে যদি কেহ সংস্কৃতজ্ঞ বা শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত থাকেন, তাহা হইলে তিনি কথকের ভুল ব্যাখ্যা শুনিয়া তাহার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইতে পারেন। থিয়েটার বা যাত্রায় অভিনেতাদিগের পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হয় না। নাট্যোল্লিখিত ব্যক্তিদিগের কথ্য বিষয় কণ্ঠস্থ করিতে পারিলে এবং তাহা যথোপযুক্ত হাবভাব সহ আবৃত্তি করিতে পারিলেই অভিনেতার কৰ্ত্তব্য শেষ হয়। তাহার পর যাত্রা বা থিয়েটারে কেহ রাজার ভূমিকায়, কেহ রাণীর ভূমিকায়, কেহ বিদুষকের ভূমিকায় রঙ্গমঞ্চে বা আসরে অবতীর্ণ হন। কিন্তু কথক-ঠাকুরকে একাই সমস্ত ভূমিকা গ্রহণ করিয়া অভিনয় করিতে হয়। র্তাহাকে পুরুষ ও নারী উভয়েরই কণ্ঠস্বরের অনুকরণকরিয়া কখনও রাজা আবার কখনও রাণীর কথ্য বিষয় বলিতে হয়। র্তাহার বক্তৃতাতে বীররস, রৌদ্ররস, করুণ রস প্রভৃতি সকল রসেরই সমাবেশ করিতে হয়। করুণ রসের অবতারণা করিয়া শ্রোতাদিগের নয়নে অশ্রীর প্রবাহ বহাইতে হয়, আবার পরক্ষণেই হাস্যরসের অবতারণা করিতে হয়। র্তাহার কথা শুনিয়া যখন শ্রোতার হাস্য করিতে থাকে, তখন তিনি সহসা ভক্তিরসাত্মক গান গাহিয়া সকলের চিত্ত আকর্ষণ করেন। এইরূপে র্তাহাকে একাকী সকল চরিত্রেরই অভিনয় করিতে হয়। র্তাহাকে মধ্যে মধ্যে গান করিতে হয়, সেই জন্ত র্তাহার স্বকণ্ঠ হওয়া আবশ্বক । আবার রাগরাগিণী সম্বন্ধেও তাহার জ্ঞান থাকা আবশ্যক। সন্ধ্যাবর্ণনায় পূরবী ও মুলতান, নিশীথ-বর্ণনায় বেহাগ, শঙ্করা, জয়জয়ন্তী এবং প্রভাত-বর্ণনায় ভৈরব, ভৈরবী প্রভৃতি রাগরাগিণীর আলাপ করিয়া শ্রোতাকে মুখ করিতে হয়। সেকালের উৎসৰ SsS স্বতরাং কথকের কার্ষ্য যে কত কঠিন, তাহ সহজেই অনুমেয়। সেকালে এইরূপ সৰ্ব্বগুণসম্পন্ন কথক প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যাহত। এইরূপ শিক্ষার সহিত আনন্দ বিতরণের ব্যবস্থা অন্য কোন সমাজে দেখিতে পাওয়া যায় না। পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে আমাদের সমাজে যে-সকল অনিষ্টকর ব্যাপার ঘটিয়াছে, তন্মধ্যে, সেকালের যাত্র এবং কথকতার প্রতি লোকের অনাসক্তি অন্যতম। যাত্রা এবং কথকতা সেকালে উৎসবের অঙ্গ-স্বরূপ ছিল । শর্করামণ্ডিত তিক্ত ঔষধ-বটিকা যেরূপ লোকে আগ্রহ সহকারে গলাধঃকরণ করিয়া রসনার তৃপ্তি সাধন ও ব্যাধির প্রতিকার করে, সেকালের যাত্রা ও কথকতা সেইরূপ জনসাধারণকে অনাবিল আনন্দ প্রদান করিত, সঙ্গে সঙ্গে তাহদের ধৰ্ম্মবুদ্ধিকে তীক্ষতর করিত, তাহাদের চরিত্র গঠন করিত। অামাদের মনে হয় যে, পৌরাণিক যাত্র এবং কথকতার পুনঃপ্রবর্তনে সমাজ-নেতৃগণের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া উচিত। এখনও যে বাংলাতে কোন উৎসব নাই, তাহা নহে। কিন্তু আমার মনে হয় যে, সেকালের মত একালের উৎসবে লোকের আস্তরিকতা পূর্ণভাবে প্রকাশ পায় না। সেকালের লোকে যেমন আমোদে উন্মত্ত হইতে পারিত, প্রাণ খুলিয়া উচ্চহাস্য করিতে পারিত, একালের লোকে সেরূপ পারে না। একালের লোকে এই আনন্দ উপভোগের ক্ষমতা হারাইয় আপনাদের অক্ষমতাকে সভ্যতা নামে অভিহিত করিবার চেষ্টা করে। একালের লোক থিয়েটার, বায়স্কোপ বা টকিতে যে অর্থব্যয় করে, তাহাতে অনেক কথক ও যাত্রাওয়ালার জীবিক নিৰ্ব্বাহিত হক্টতে পারে। অবশু থিয়েটার, সিনেমা প্রভৃতি যখন এদেশে আমদানী হইয়াছে, তখন উহা দেশে থাকিয়াই যাইবে, হাজার চেষ্টা করিলেও উহা দেশ হইতে যাইবে না। কিন্তু উহাদের সাহায্যে লোকশিক্ষার বিস্তার না হইয়া যদি বিপরীত ফল হয়, তাহা হইলে আমাদের একান্ত দুর্ভাগাই বলিতে হইবে। থিয়েটার সিনেমার পরিচালকগণের দৃষ্টিও এ-বিষয়ে আকৃষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। 芋