পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

_আক্র্যহারণ ছবি হয়ত তাহার কাজ শেষ হইয়া গিয়াছে, স্বধাকে রাত্রিশেষে উঠা নূতন জগতে নূতন পথ, নূতন বন্ধনের সন্ধানে ঘুরিতে হইবে। ( >> ) সারি সারি তেল-কলের ধূমোদগারী চিম্নীর পাশে ধূম্ৰপঙ্কিল আকাশের নীচের এই খাচার মত বাড়ীটিতে নুতন করিয়া সংসার মুরু হইল। চিম্‌নীর গায়ে মাঝে মাঝে দুই-চারিটি তাল ও নারিকেল গাছ দেখা যায়, আর কুলি ব্যারাকের একটা পাকা বাড়ীর সাম্নে একটা পুকুরে অষ্ট প্রহর মজুরদের ছেলেরা স্নান করে ও ঝাপাই জোড়ে। এই দুইটি জিনিষেই পুরাতন পৃথিবীর একটুখানি আমেজ লাগিয়া আছে, নহিলে ইহাকে পাতালপুরী কি নাগলোক বলিলেও স্বধার অবিশ্বাস হহঁত না । বাম্বকীর মাথার ঠিক উপরেই বোধ হয় এই কলিকাতা শহর, তাই সারাদিনরাত্রিই ঘর বাড়ী এমন থর থর করিয়া কাপে ! পথে অহরহ যে ভারী ভারী গাড়ীগুলা চলে তাহারাই যে মাতা ধরিত্রীর বুকে এমন শিহরণ তুলে তাহা বুঝিতে স্বধার কিছু দিন সময় লাগিয়াছিল। জনবিরল নয়ানজোড়ে যেটুকুও বা মানুষের সঙ্গ পাওয়া যাইত, এখানে তাহার সিকিও পাওয়া যায় না। উৰ্ম্মিমুখর বেলাভূমিতে বসিয়া নিঃসঙ্গ মানুষ সারাদিন সমুদ্রের বিচিত্র রাগিণী শুনিলেও যেমন তাহার ভাষা বুঝে না, এ অনেকটা সেই রকম। ভোর হইতে কত বিচিত্র শব্দতরঙ্গই যে কানের উপর দিয়া ভাসিয়া যায় তাহার ঠিক নাই, কিন্তু এ বিশাল নগরীর অষ্টপ্রহরের ভাষা বুঝিতে সময় লাগে। গলির ভিতরে বাড়ী, রাজপথের জীবনলীলা চোখে পড়ে না, কিন্তু ধ্বনি জানাইয়া দেয় একের পর এক করিয়া ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্বের পটক্ষেপ হইতেছে। ভোরবেলা ঘুম চোখ হইতে ছাড়িবার আগেই তৈলহীন রথচক্রের ঘর্ঘর ধ্বনি ও এক বোঝা বাসন আছড়ানোর মত ধাতব আৰ্ত্তনাদে স্থখস্বপ্নের শেষ রেশটুকু মিলাইয়া যায় ; তার পর নিকটে শোনা যায় পিচকারীর জলের ঝঝর শব্দ আর দূর হইতে কানে আসে হুদীর্ঘ অনুনাসিক স্বরে কত বাশির আকাশ-কাপানো ডাক। মহামায়া বাশির শবেই শয্যা ছাড়িয়া উঠিয়া বসিয়া বলিতেন “ঐগে, তোমাদের শুামের বঁশি বাজল।” অলম্ব-ৰোগরণ ২১ত সুদীর্ঘ দিন ধরিয়া রাজপথের অগণ্য বিচিত্র যানবাহন তাঁহাদের বিচিত্র ভাষায় সশঙ্কিত পথিককুলকে সতর্ক করিতে করিতে চলিয়াছে। কেহ ভারী গুরুগম্ভীর গলায় থাকিয়া থাকিয়া বলে “ঢং ঢং”, কেহ একটানা ছন্দে গাহিয়৷ চলিয়াছে “ঝম্ ঝম্ ঝম্ ঝম্‌’, কেহ ক্ষীণ যুদ্ধতালে একটি ঘুঙুর বাজাইয়া চলিয়াছে "টুটা, টুটাই" কেহ বড় মানুষের ক্রুদ্ধ হঙ্কারের মত একবার তীব্র গর্জন করিয়া ঝড়ের বেগে চলিয়া যাইতেছে, কেহ চপল বালকের মত অৰ্দ্ধেক ডাক অসমাপ্ত রাখিয়াই দৌড়িয়া চলিয়া যাইতেছে। তাহাদের চলার হ্রস্ব ও দীর্ঘ তাল, তাহাদের বাণীর তীব্র ও মধুর স্বর মনে নানা ছবি জাগাইয়া তুলে কিন্তু সে তুরঙ্গগামিনী বাষ্পবাহিনীদের ত চোখে দেখা যায় না। গলিতে রমণীর স্বতীব্র কণ্ঠ ডাকিয়া বলে, “ম-আ-টি লিবি গো-ও,” কিন্তু পৃথিবীতে মাটির মত স্থলভ জিনিষকে এমন করিয়া হাকিয়া বেড়াইবার কি প্রয়োজন আছে শহরে নবাগত মৃধা বুঝে না। পুরুষের কণ্ঠ বলে, “কাপড়াওয়ালা—অl,” “বডি-জামা-সেমিজ” “জয়নগরের মোয়া ।” অন্ন-বস্ত্রের কথা না বুঝিয়া উপায় নাই, বুঝিতেই হয়। হঠাৎ শুনা যায় শিশুকন্ঠ উত্তেজিত হইয়া চীৎকার করিতেছে, “নথিং, নট, কিছু ;” তাহার যে পৃথিবীর অনিত্যতার বিষয়ে বক্তৃতা করিতেছে না এ কথা বুঝা অত্যন্ত সহজ, কিন্তু তবু প্রকৃত তত্ত্ব অনাবিষ্কৃতই থাকিয়া যায়। সন্ধ্যাবেলা আশেপাশের নানা বাড়ী হইতেই গানের স্বর ভাসিয়া আসে। মেসের ছেলেরা গায়, “যদি এসেছ এসেছ বঁধু হে দয়া করে কুটীয়ে আমারি।” বাড়ীওয়ালার বাড়ী হইতে কলের স্বর আসে, “আহা, জাগি পোহাইল বিভাবরী, অতি ক্লাস্ত নয়ন তব, স্বনারী।” গলির ওপারের বাড়ীর মেয়েরা ওস্তাদজীর সহিত গলা মিলাইয়া গায়, “আজু খাম মোহলীন বঁাশরি বাজাওয়ে কে ?” সঙ্গে সঙ্গে এস্রাজের ছড় ঝঙ্কার দিয়া উঠে। গান শুনিয়া শিবুর দিল খুলিয়া যায়, সেও গঙ্গাজলের ট্যাঙ্কে চড়িয়া দুই হাতে ট্যাঙ্ক পিটাইয়া মেসের ছেলেদের ভঙ্গীতে গাহিতে মুরু করিয়া দেয়,