পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পাৰ্ব্বতীর কথাগুলির মধ্যে আহত অভিমানের নীরসতা এমন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছিল যে শচীন্দ্রের অভিমানকে তা আঘাত না করে পারল না। তবু একটু শুষ্ক পরিহাসের হাসি মুখের উপর টেনে এনে সে বললে, “দুঃখের কারণই ত এতদিন ছিল, নিজের প্রতি নিষ্করুণ ছিলুম ব'লে। আজ তারই প্রতিকার করতে চাইছি। এখন করুণাটা তোমার উপর, ন, আমার নিজের, তাই আজ পরখ করে দেখতে চাই । নইলে দেখছ না—” পাৰ্ব্বতী স্পষ্টই দেখলে যে শচীন্দ্রের চিত্ত আজ তার কথা গভীর ভাবে গ্রহণ করবার অবস্থায় নেই। সে আজ সকল কথাকেই লঘুতার স্পর্শে আপাত মনোরম করে তুলতে চায় ; এবং যে-প্রেম একপ্রকার নিবেদন করাই হয়ে গেছে তাকে মঞ্জুর-ভাবে কথাটাকে আপাতত চাপা দিয়ে বিদায় নিয়ে যাওয়া তার অভিপ্রায় । সে শচীন্দ্রের কথা অসমাপ্ত রেখে তাকে বাধা দিয়ে বললে, “আপনি আমার কথা ঠিক বুঝতে পারেন নি। দিনে দিনে তিলে তিলে যার স্থতি আপনার সমস্ত জীবন সমগ্র অস্তিত্বকে পুর্ণ করেছে, সার্থক করেছে, একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানেই তার মহা অবসান ঘটল এমন মিথ্য। কথা আপনি নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করবেন না ; আমাকেও না।” শেষ কথাগুলিতে শচীন্দ্রকে যেন কশাঘাত করলে। সে চুপ করে চলতে লাগল। নিজের বাচালতা ও লঘুতায় নিজেকে এমন মূল্যহীন করাতে নিজের উপর তার বিরক্তির আর সীমা রইল না। ভাবতে ভাবতে এক সময় মনে মনে আজকের সমস্ত ঘটনা সে পৰ্য্যালোচনা ক’রে দেখলে এবং নিজের প্রেম যে সে সুস্পষ্ট করে নিবেদন করে নি এই কথা তার অভিমানমূঢ় চিত্তে যেন কথঞ্চিৎ সাশুনা দান করলে। পাৰ্ব্বতীর উক্তির স্থত্রে যেন সে আপাতমুক্তির পথ খুজে পেল। সে নিজেকে এই বলে বোঝাল যে, পাৰ্ব্বতীর কথাই ঠিক। সত্যিই পাৰ্ব্বতীর দুঃখদৈন্তপূর্ণ বঞ্চিত জীবনের প্রতি করুণাতেই তার এই রজ্জ্বভ্রম’। হয়ত কৃতজ্ঞতাকেই সে প্রেম বলে মনে করছে। হয়ত পাৰ্ব্বতীর গুণের প্রতি অতিমাত্র পক্ষপাতিত্বকে সে প্রেম বলে ভুল করেছে। নিজের অন্তরের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে সে দেখলে, সে তার নিরদিষ্ট পত্নীর স্মৃতিকে চিরজাগ্রত রাখার চেষ্টায় তিলে তিলে পলে পলে নিজের সমস্ত বিত্ত সমস্ত শক্তি সমস্ত জীবনকে উৎসর্গ ক’রে চলেছে। দেখলে যে এই দীর্ঘ চার-পাচ বৎসরের মধ্যে এ-ভিন্ন তার অন্য কাজ ছিল না, অন্ত চিন্তা ছিল না; এই প্রতিষ্ঠানকে স্বন্দর সম্পূর্ণ করবার প্রয়াস ব্যতীত স্বতন্ত্র অন্য ব্যক্তিত্ব পর্য্যন্ত অবশিষ্ট ছিল না । সে অারও দেখলে, এই নারী—যার প্রতি আকর্ষণকে সে আজ প্রেম বলে কল্পনা করছে—এই নারীও সেই বৃহৎযজ্ঞের সমিধ মাত্ৰ ; দ্বিধাহীন নিঃসঙ্কোচে সে তাকে এই যজ্ঞে বলি দিতে কুষ্ঠিত হয় নি। ষে-স্মৃতি এত বৃহৎ হয়ে তার সমস্ত জীবনকে ওতপ্রোত রূপে আচ্ছন্ন ক'রে রেখেছে তাকে তার জীবন থেকে বাদ দেবে কোন উপায়ে ? এমনি ক’রে নিজেকে বুঝিয়ে বিদায় নিয়ে সে লঞ্চে গিয়ে উঠল । পাৰ্ব্বতীর দুঃখের প্রকৃত স্বরূপ স্পষ্ট করে উপলব্ধি করার মত মন তার স্বচ্ছ ছিল না। চিস্তা সে সূক্ষ্মভাবেই করত, কিন্তু সে-চিন্তা ছিল একদেশদশী। পাৰ্ব্বতীর মনের মধ্যে যে তরঙ্গ তুলে তার চিরবিধুর চিত্তের শান্তি এবং শ্রাস্ত নয়নের নিজ হরণ করে নিয়ে তাকে তার শূন্ত গৃহে এবং শুষ্ক কৰ্ম্মক্ষেত্রে বিসর্জন দিয়ে গেল, শচীন্দ্রের আত্মপ্রতারিত আত্মকেন্দ্রানুগ চিত্তে তার খবর পৌছল না। অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে চিন্ত না করে নিতান্ত সহজ ভাবে নিজের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই এ-কথা তার কাছে অস্পষ্ট থাকত না যে, চার বৎসর পূর্বে তার পত্নীকে স্মরণ করে যে-উদ্যোগ সে আরম্ভ করেছিল তার পত্নী সেই বিপুল আয়োজনের অন্তরালে একদিন নিশ্চিহ্ন-সমাধি লাভ করেছে। কত দিনের পর দিন অতিবাহিত হয়েছে, কমলা তার মনের স্মৃতিপটে ছায়াপাত মাত্র করে নি ; কমলাপুরী হয়েছে তার আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বষ্টি এবং সেই স্বষ্টির প্রত্যেক বৰ্গইঞ্চি তার চিত্তে পাৰ্ব্বতীর জীবন্ত প্রত্যক্ষতায় পরিপূর্ণ। নিজের গৃহকোটরের মধ্যে প্রত্যাবৰ্ত্তন ক’রে একটা অসীম শূন্তত একটা অপূৰ্ব্বানুভূত রিক্ততা পাৰ্ব্বতীর সমস্ত বুকের মধ্যে হাহাকার ক’রে উঠল। শয়নকক্ষের তপ্ত আবেষ্টন পাৰ্ব্বতীর কাছে মৃত্যুপারের নিশ্বাসনিরোধী সমাধিগহবরের মত মনে হ’তে লাগল। দ্রুতপদে বারান্দায় বেরিয়ে সে