পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অগ্রহায়ণ শচীন্দ্রের পরিত্যক্ত তার নিত্য আশ্রয়দাত্রী আরামকেদারাটির ক্রোড়ে এসে এলিয়ে পড়ল । শচীন্দ্রের সাগ্রহ আত্মনিবেদনের উচ্ছ্বাসকে রূঢ় আঘাতে সংযত করে তার নিজেরই উন্মুখ বুভুক্ষিত চিত্তকে যে সে বঞ্চিত করেছে সে-কথা তার মনে এল না। ঐ যে বিরহবিধুর বৃহৎশিশু নিতান্ত নির্ভরপরায়ণ হৃদয়টিকে নিয়ে একান্ত ব্যাকুল বিশ্বাসে এসে তার হৃদয়-বাতায়নে তার স্নেহের আশ্রয় আকাঙ্ক্ষা ক’রে বড় আশায় তার দিকে হাত বাড়িয়েছিল মূঢ় অনাথের মত শচীন্দ্রের সেই মুখের ভাবখানা পাৰ্ব্বতীর প্রেমাৰ্ত্ত চিত্তকে পীড়িত করতে লাগল। তার নিজের আচরণ তার কাছে অহঙ্কারপ্রস্থত কৃত্ৰিম আত্মসম্মানের অভিনয় বলে মনে হ’ল। শচীন্দ্রের গভীর মেহের বাস্তব স্পর্শ যেন সে হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করলে। তার অমৃতপ্ত চিত্ত মনে মনে শচীন্দ্রের ব্যথিত মূৰ্ত্তিকে কল্পনায় তার কাছে টেনে নিয়ে স্নেহে সমাদরে তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে যেন বারম্বার সাত্বনা দিতে লাগল। উচ্ছ্বসিত অশ্রুরাশি বাধা মানতে চাইল না এবং মনে মনে সে সংকল্প করলে যে এমন বেদনাপীড়িত চিত্তে শচীন্দ্রকে সে বিদায় নিয়ে ধেতে দেবে না। ভোরবেলা নদীর ধারে গিয়ে হাসিমুখেই সে শচীন্দ্রকে বিদায় দিয়ে আসবে ; জানিয়ে আসবে যে তার মনের তিক্তত দূর হয়ে গেছে, তার মনে আর কোন সংশয় নেই। - ভোরের দিকে চেয়ারের উপরেই তার ক্লাস্ত মাথাটা হেলিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালের রোদের রূঢ় আঘাতে চোখ মেলে যখন তার ঘুম ভাঙল, লঞ্চ তখন গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূরে চলে গিয়েছে। মনটা তার অত্যন্ত ম্ৰিয়মাণ হয়ে গেল, কিন্তু কাল রজনীর অমৃতাপের তীব্রতা তার মনের মধ্যে যেন স্থান পেল না। শচীন্দ্রের প্রতি তার আচরণের রুক্ষ্মতা তার মনে বেদনার সঞ্চার করলেও তার গোপনতম চিত্তের নিভৃতে যেন একটা অমুমোদনের স্বর তার ব্যথিত হৃদয়কে সান্থনা দিতে লাগল। পাৰ্ব্বতী নিজেকে এই অলস কল্পনাযয় ভাবরাজ্যের অবসাদ থেকে জোর করে ছিনিয়ে তার দৈনন্দিন কৰ্ম্মজীবনের নীরন্ধ, অনবসরের মধ্যে টেনেনিয়ে উপস্থিত করলে। মনে মনে বললে, “ন, শান্তিপূর্ণ রসোত্তপ্ত গৃহবিলাস আমার ত্ৰিবেণী ২৭৩ জন্য নয় ; আমৃত্যু এই সমাধিগহবরে বসে মৃতদেহে জীবনসঞ্চারের ব্ৰত আমার। দুৰ্ব্বল হলে আমার চলবে না।” ভোরবেলা লঞ্চ ছেড়ে যাবার সময় শচীন্দ্রের অভ্যাসমত সে লঞ্চের বারান্দায় এসে দাড়াল। আকাশে শুকতারা তখন স্নান হয়েছে, আকাশ উজ্জল হতে দেরী নেই। আসন্ন আলোকোচ্ছ্বাসের পূর্ববর্তী স্বচ্ছতিমিরাবরণে জলস্থল আকাশের উপর যেন একটা অসাড়তার মোহ । গ্রামের প্রাস্তবত্তী ঘাটটুকু যখন ছাড়িয়ে গেল তখন শচীন্দ্রের মনটা হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে পড়ল। কালকের বিদায়-সম্ভাষণের মধ্যে কোথায় যেন একটা বিদারণ-রেখা পড়ে গিয়েছে। সেই কথাটাই সে তার মনের মধ্যে সারা রাত একটাচাপা স্বপ্নের মত যেতে বসেছিল, এভক্ষণ সে কথা মনে হয় নি। প্রতিবারকার বিদায়ের মধ্যে আগামী বারের মিলনের আশা নিয়ে তারা দূরে যায়। তার সঞ্জীবনীশক্তি তাদের সমস্ত কৰ্ম্মচেষ্টাকে প্রাণে, আনন্দে, সৌন্দর্ঘ্যে একে অন্যের কাছে আরও মধুরতর নিকটতর করে তোলে। পাৰ্ব্বতীর শেষ কথার কোন উপযুক্ত প্রত্যুত্তর সে দেয় নি ; অথচ তার ব্যবহারে পাৰ্ব্বতীকে আঘাত করেছে অল্প নয়। বিদায়-মুহূর্তে পাৰ্ব্বতীর বেদনাবিবৰ্ণ মুখ, এবং হাত না বাড়িয়ে ‘গুড় বাই’ বলার ভঙ্গীটা স্মরণ করে তার মনটা পীড়িত হতে লাগল। এতক্ষণে নিজের আচরণের বিসদৃশতা অনুভব সে করতে পারলে । বুঝতে পারলে যে, উচ্ছ্বাসের আবেগে পাৰ্ব্বতীকে প্রেম-নিবেদন করাও চলে না, আত্মরক্ষার্থে সাধু সাজাও তার কাছে নিম্প্রয়োজন। আর যাই হোক, পাৰ্ব্বতীর সঙ্গে আচরণে লঘুতা চলবে না। পাৰ্ব্বতীর সমাজ নেই, কোন মিথ্যা আচারের আবরণ তার আবশ্যক করে না । তার সঙ্গে ব্যবহারে খাটি হওয়া চাই। সেই শক্তি মনের মধ্যে তাকে পেতেই হবে—ত সে পাৰ্ব্বতীকে গ্রহণ করার দিক থেকেই হোক বা তাকে প্রত্যাখ্যানেই হোক। এখনই লঞ্চ ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে পাৰ্ব্বতীর কাছে ক্ষমা চাইতে পারলে তার মনটা যেন স্বস্থ হয় এমনি তার মনে হতে লাগল। নদীর তীরে তীরে গ্রামের ঘাটে তখন ভোরের জাগরণ স্বরু হয়েছে। সেই সহজ সরল স্বচ্ছন্দ নিশ্চিন্ত জীবনযাত্রার অনাময় শাস্তি তার মনকে অকারণে ব্যথিত করে তুললে। বিক্ষিপ্ত বিধ্বস্ত জলরাশি বিদীর্ণ করে লঞ্চ তখন পূর্ণ বেগে