পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/২৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছুটে চলেছে। একান্ত অসহায় বন্দীভাবে শচীন্দ্র সেই বিধুনিত ফেনপুঞ্জের দিকে চেয়ে নিঃশবে দাড়িয়ে রইল । Web নিখিলনাথ কিছু দিন কমলের কোন সংবাদ নিতে পারে নি। তার চিত্ত সীমার চিস্তায় এমন নিবিষ্ট ছিল যে নিতান্ত অবশ্যকৰ্ত্তব্য ছাড়া সে হাসপাতালের আর কারও সংবাদ নেবার অবসর পায় নি। আজ কমলের পীড়ার সংবাদে সে নিজের এই আবিষ্টতা প্রথম লক্ষ্য করলে এবং লজ্জিত হয়ে তাকে দেখতে গেল। মনোযোগ দিয়ে রোগীকে পরীক্ষা করলে এবং নাস বিন্দুকে ডেকে মাথায় বরফ দিতে উপদেশ দিয়ে, একটা ঘুমের ওষুধ লিখে দিয়ে সে চলে গেল। কিছুদিন যাবৎ লিখিলের নিজের মনও বিশেষ চিন্তা ও উদ্বেগে পীড়িত ছিল। সেই যে অন্ধকার আকাশের তলে সীমাকে সে অসীম বিশ্বের অন্তরালে কোথায় বিসর্জন দিয়ে এসেছে, তার পর এই ক-মাস অতীত হতে চলল বহু অম্লসন্ধানেও সে তার সংবাদ পায় নি। যে নিবিড় স্পর্শটুকু সীমা তার কোমল করপল্লবের আকর্ষণে তার অস্তরের মধ্যে স্থায়ীভাবে মুদ্রিত করে দিয়ে গেল, সে তার অস্তরের স্বপ্ত প্রেমের রক্তকমলকোরককে শতদলে পরিণত করেছে। সে যে সত্যবানের হাতের দান এ-কথা তার কাছে বাহ মাত্র, সে যে সীমার হাতের স্বৰূঢ় প্রত্যাখ্যান এই কথাটাই তার পুরুষের চিত্তকে অধিকতর মথিত করেছে। নারীহৃদয়ের উপর আধিপত্য বিস্তারের যে স্বাভাবিক চিরন্তন প্রাকৃতিক নিয়ম তারই ব্যত্যয়ে আজ তার চিত্ত এই দুরন্ত মেয়েটির প্রতি উদ্বিগ্ন আগ্রহে প্রধাবিত ; সৰ্ব্বনাশের ঝোড়ো হাওয়ায় ছিন্ন-পাল ভগ্নতরী নিয়ে যে উন্মত্ত উচ্ছ্বাসে অকুল সমুত্রে পাড়ি দিল, হায় রে, তাকে কোন মৃত্যুহীন প্রেমের জীবনতরীর সাহায্যে সে ফিরিয়ে আনবে ? নিখিল চলে যাবার পর বিন্দুকে আলোটা নিবিয়ে দিতে অনুরোধ করে, কমল চুপ ক’রে পড়ে রইল। রাজ্যের খামখেয়ালী চিন্ত পঙ্গপালের মত তার সমস্ত সংজ্ঞারাজ্য জুড়ে অকারণ চাঞ্চল্যে উড়ে উড়ে বেড়াতে লাগল। তার ঘুম কোথায় ছুটে গেল এবং গভীর রাত্রিতে এক সময়ে অত্যন্ত অকারণে তার নিজের মস্তিষ্কের দ্রুত প্রবাহিত রক্তস্রোতের উত্তেজনায় সে বিছানা থেকে নেমে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। হঠাৎ পায়ের শব্দে জেগে বিন্দু উঠে বললে, “ওম, ওকি ভাই, কি চাই ? আমাকে ডাকৃলে না কেন ? যাও, শোও গে, আমি দিচ্ছি। কি চাই বল ত ?” কমল তৎক্ষণাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে বুঝতে পারলে যে চিন্তার উত্তেজনায় সে উঠে পড়েছিল ; এবং কোন প্রকার উপযুক্ত কৈফিয়ং সহসা সংগ্রহ করতে না পেরে তাড়াতাড়ি বললে, “দু-একটা বিস্কুট কি একটু মিশ্ৰী যদি দাও, একটু জল খাব । হঠাৎ কেমন থিদে পেয়ে গেছে, মনে হচ্ছে।” কথাটা সত্য নয় এবং কমলের পক্ষে আহারের চেষ্টা তখন প্রায় অত্যাচারের সামিল, তবু তাকে বিন্দুর সযত্নসংগৃহীত সেই কণ্ঠরোধকারী শুষ্ক বিস্কুটখণ্ড জলের সাহায্যে কিঞ্চিৎ গলাধঃকরণ করতেই হ’ল,—এবং নিজের এই অবস্থা স্মরণ ক’রে এত কষ্টেও তার হাসি এল । বিন্দু বললে, “যাকৃ, তবু দু-দিন পরে মুখে একটু হাসি ফুটল। যা মুখ করেই ছিলে। মাথাটা একটু কমেছে, না ?” কমল বললে, “হ্যা ভাই, মিছিমিছি তোমার ঘুমটী ভাঙিয়ে দিলুম। যাও শোও গে, আর কিছু দরকার হবে না। দরকার মত ওটুকু আস্তে আস্তে খাব’খন " জ্যোৎস্না কতকটা সুস্থ বোধ করছে কল্পনা করে বিন্দু আবার স্বস্থানে গিয়ে গুয়ে পড়ল৷ চিন্তার ফুল পাওয়া যায় না। নন্দলালের অনুতাপবিড়ম্বিত পত্র তাকে কোন সাত্বনার পথ দেখায় না। এখনও কিছুদিন হাসপাতালের শিক্ষাকালের অবশিষ্ট আছে। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করতে হ’লে এই সময়টুকু তার কোনক্রমে অতিবাহিত করা ছাড়া উপায় নেই। তার সস্তানের ভবিষ্যৎ এবং তার নিজের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্বাধীনতার পথ এ ছাড়া সে কিছু চিন্তা করে উঠতে পারে না। তা ছাড়া মালতীর সম্বন্ধে তার কৰ্ত্তব্য অত্যস্ত জটিল । যে-মেহের আবেষ্টনে সে তার সন্তানকে পুত্ৰাধিক স্নেহে বেঁধে রেখেছে তার থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করবার মত নিষ্ঠুরতা চিন্তা করতে তার করুণায় শুধু নয়, তার কৃতজ্ঞতায় বাধে। অথচ কোন প্রকার সম্বন্ধ-স্বত্র রক্ষা করে নন্দলালের বিভ্রান্ত চিত্তের প্রবল উন্মুখীনতা থেকে সে ষে কেমন করে নিজের শাস্তি