পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৩০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছোট কিন্তু ভারি স্বপ্তে একটি স্মৃতিমন্দির আছে, অনেকটা তিব্বতীয় রীতিতে গঠিত, মৰ্ম্মর প্রতিমূৰ্ত্তিটি অতি স্বন্দর। কালিম্পঙের প্রধান দ্রষ্টব্য হচ্ছে ডক্টর গ্রেহাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অনাথ ফিরিঙ্গি ছেলেমেয়েদের আশ্রম। শহরের অনেক উচুতে অনেকটা জায়গা সরকার এই আশ্রমের জন্য দিয়েছেন। এখানে ছেলেমেয়েদের ও শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীদের থাকবার জন্য অনেকগুলি সুরম্য অট্টালিকা নিৰ্ম্মিত হয়েছে, স্কুল, গির্জ, খেলার মাঠ, হাসপাতাল প্রভৃতি সবই আছে। আশ্রমের নিজস্ব আধুনিক ধরণের গোশাল, চাষের জমি ও বাগান দেখবার জিনিষ । ছেলেদের পাল করে সেপানে কাজ করতে হয়, যাতে তারা স্বাবলম্বী ও শ্রমশীল হতে পারে। আশ্রম বাজার থেকে যথেষ্ট দূরে, তাই ট্যাক্সি করে এক দিন সকালে গেলাম। পথে কয়েকটি বৌদ্ধ-গুম্ফা’ বা মঠ দেখলাম, সবই আধুনিক ও বৈশিষ্ট্যহীন, লামাদের দেখেও বিশেষ শ্রদ্ধা হ’ল না। ডক্টর গ্রেহামের আশ্রমে যেতে হ’লে কালিম্পঙের সৰ্ব্বোচ্চ পাহাড়ে উঠতে হয়—উপর থেকে নীচের শহর ও দিগন্তবিস্তৃত অরণ্যসস্কুল উপত্যকার দৃগু ভারি মনোরম লাগে। আশ্রমের গির্জাগুলির গঠনসৌন্দৰ্য্য চিত্তাকর্ষক, আগন্তুকদের ভিতরে গিয়ে দেখতে দেওয়া হয়। এই আশ্রমটির বিস্ময়জনক প্রসার ও পৃথিবীজোড়া খ্যাতি সম্ভব হয়েছে ঋষিতুল্য প্রতিষ্ঠাতার অনন্যসাধারণ অধ্যবসায়, নিষ্ঠা ও আত্মোৎসর্গের জন্য। শুনলাম অর্থাভাবে অনাথ শিশুদের সংখ্যা এখন আগের চেয়ে কম, তবু এখনও পাচ শ-র বেশী ছেলেমেয়ে এখানে च्यांtछ् । গ্যাণ্টক দেখবার ইচ্ছা গোড়া থেকেই ছিল, তবে একা যেতে মন চাইছিল না। সৌভাগ্যবশতঃ সঙ্গী জোগাড় হতে কিন্তু বিলম্ব হয় নি। হোটেলে আরও দু-জন আমারই মত সিকিম দেখবার জন্য সমুংমুক ছিলেন। আমার প্রস্তাবে র্তার সানন্দে যেতে রাজি হলেন। একজন পাশী ভদ্রলোক, মিষ্টার দেশাই, সিঙ্গার সেলাই কল কোম্পানীর স্থানীয় হিসাবপরীক্ষক ; আর দ্বিতীয় ভদ্রলোক বাঙালী, দত্ত-মহাশয়, তিনি কলগেট-পামঅলিভ সোপ কোম্পানীর ভ্ৰাম্যমান প্রতিনিধি। দুজনেই বেশ অমায়িক লোক, তাই তাদের মত সঙ্গী পাওয়ায় গ্যান্টক-যাত্রা খুবই প্রতিকর হয়েছিল। একটি বাঙালী ট্যাক্সি-চালকের গাড়ী যাতায়াতের জন্য ঠিক করা হল । আমরা সকালে জলযোগ করে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়ুজ্যে-মশায় সঙ্গে দিয়ে দিলেন দুপুরে খাওয়ার প্রচুর লুচি, তরকারী, ডিম ইত্যাদি এজন্য র্তাকে আমরা অস্তরের সহিত ধন্যবাদ জানালাম। তিনি ও র্তার ছেলে ও মেয়ে ডাকঘর অবধি আমাদের পৌছে দিয়ে গেলেন। ছেলেটি ত কেঁদেই অস্থির, সে গো ধরল আমাদের সঙ্গে যাবেই। অনেক কষ্টে তাকে বাড়জ্যে-মশায় ভুলিয়ে, শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলেন। তিস্তা-ব্রিজ অবধি ঢালু পথে নেমে এসে আমরা গ্যাণ্টকের পথ ধরলাম। একদিকে কলম্বন তিস্ত ভীমবেগে প্রধাবিত, আর জলের প্রায় পাশাপাশি পথ গিয়েছে নিবিড় অরণ্যানীর গা ঘেসে, দু-দিকে গগনচুম্বী শ্বাপদসঙ্কুল শৈলরাজি —মাঝে মাঝে ছোট-বড় ঝরণা পথের তলা বেয়ে তিস্তায় এসে মিশছে। কত রকম যে অপরিচিত গাছপালা ও উদ্ভিদ দেখা গেল তা অামার মত অবৈজ্ঞানিকের বোঝা অসম্ভব। হিমালয়ের এ দিকটা সত্যই অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্ঘ্যের লীলাভূমি। বনবিহঙ্গের কলকাকলি, তিস্তার উচ্চ নিনাদ, ও পৰ্ব্বতের মৌন গাম্ভীৰ্য্য—সব মিলে মনকে যেন প্রতিমুহূর্তে সমাহিত করে দেয়। শিলিগুড়ি থেকে আসবার সময়ে তিস্তার এত কাছ দিয়ে যাই নি, গ্যান্টকের পথ তাই অারও স্বন্দর লাগল। বেলা দশটা নাগাদ রংপুব্রিজ পৌছালাম—এইখানে ব্রিটিশ-ভারতের সীমানা। রংপু নদীর ওপারে সিকিম-রাজ্যের আরম্ভ। রংপুব্রিজের ধারে সরকারী পুলিসের ঘাটি আছে, এইখানে পুলিস আমাদের পাস দেখতে চাইলে । বড় মুস্কিলে পড়লাম—আগে থেকে একেবারেই জানা ছিল না যে, সিকিম যেতে হ’লে বাঙালীদের পাস নিতে হয়, তাই পাসের কোনরূপ ব্যবস্থা করা হয় নি। মিঃ দেশাই ত নিজের কার্ডে লিখে দিলেন যে তিনি পাশী বলে তার পাস রাখার দরকার হয় নি। দত্ত-মহাশয় ও আমি অবশেষে বুদ্ধি করে আমাদের কালিম্পঙ আসার অনুমতিপত্র দেখিয়ে কোনরূপে রেহাই পেলাম। নদীর ওপারে রংপু পল্লী, সেখানে সিকিম পুলিস এক প্রকাও থাত এনে হাজির করল— আমরা নাম-ধাম, যাওয়ার উদ্দেশু প্রভৃতি লিখে দিলাম।