পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৪৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পৌষ থাকতে-থাকতেই পঞ্চাশ বার চোখের স্বমুখে ঘুরে বেড়াত, পাছে আমরা ওকে দেখতে না পাই ।” “কিন্তু জান, কাল সন্ধ্যেবেলা যখন আমরা সবাই নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছিলুম, তোমরা ত সেই উচু টিপিটার উপর বসে রইলে, আমি পা ধোবার জন্যে একেবারে জলের কিনারায় গিয়ে দাড়িয়েছি, হঠাৎ গুনি সেই রকম বঁাশীর স্বর, অনেক দূরে সেই যে ছোট একটা দ্বীপের মত জায়গা সেইখানে বসে কে বাজাচ্ছে। কত চেষ্টা করলুম দেথতে—শুধু গায়ের নীল জামাটা ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। তার পর যখন হোষ্টেলে ফিরে আসছি, দেখি হন হন ক'রে সাইকেলে চেপে সেই খারাপ লোকটা চলেছে, গায়ে একটা নীল জামা ! এত মন খারাপ হয়ে গেল আমার ” “কিন্তু আমি ঠিক বলতে পারি ও ময়। সেদিন আমার সেই দাদার বাড়ীতে গিয়েছিলুম না ? দুপুরে ঘুমিয়ে আছি, এক সময় ঘুম ভেঙে গেল, কোথাও কোন সাড়-শব্দ নেই, হঠাৎ শুনি সেই অদ্ভুত স্বরটা বাজছে—ঠিক সেই স্বরটা, তেমনি এক-একবার কানে কানে কথা বলার মত ধীরে, আবার সেই রকম গভীর উত্তেজনায় কেঁপে-ওঠা কণ্ঠস্বরের মত জোরে ; মনে হ’ল, একটু দূরের একটা বাড়ীতে কে বাজাচ্ছে। আমার দাদা বাড়ী ছিলেন না, সন্ধ্যেবেলা ফিরতে জিজ্ঞেস করলুম, ও-বাড়ীতে কেউ বাজায় নাকি। তl, দাদা বললেন, ও-বাড়ীতে এক জন বুড়ো ভদ্রলোক পেনসন নিয়ে এসেছেন, কারো সঙ্গে মেশেন না, হয়ত জানেন বাজাতে, ওঁরা কিন্তু কোনদিন শোনেন নি।” নীচের ঘড়িটাতে ঢং করিয়া একটা শব্দ হইল। “সাড়ে এগারটা বেজে গেল না ? সত্যি চিত্ৰ-দিকে ডাকলেই ভাল হ’ত কি স্তন্ধ রাত্রি দেখছিস ত, মনে হয় কানে কানে কথা বললেও যেন দূর থেকে গুনে ফেলবে, তোরা নয় থাক, আমিই ওকে ডেকে আনি, কেমন ?” বলিয়া কোন উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়াই প্রশ্নকারিণী ধীর স্বস্থাপদে বাহির হইয়া গেল । বাহিরে আর একবার বৃক্ষের পত্রে পত্রে কম্পন জাগাইয় একটা দমকা বাতাস বহিয়া গেল। একটা নিশাচর পক্ষী 8$6 ৰাণী অদ্ভূত শব্দে এই শব্দহীন রাত্রির দুয়ারে আঘাত করিয়া দূরে উড়িয়া গেল । সকলেই যেন কিসের প্রতীক্ষা করিতেছে প্রতি ক্ষণে, বহু দূর হইতে বুঝি কে আসিতেছে। * সহসা দূরে সেই বহু-আকাঙ্ক্ষিত বংশীবাদকের বঁাশতে পরিচিত স্বরটি বাজিয়া উঠিল, অতি করুণ উদাস। সমগ্র বিশ্বের বিরহী আত্মার যুগযুগান্তরের বিরহবেদন বুঝি আজিকার নীরব রাত্রির নিবিড় নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া মূৰ্ত্ত হষ্টয়া উঠিল। জ্যোৎস্নাহসিত তটিনীর তরঙ্গায়িত বক্ষের উপর দিয়া বিস্তীর্ণ বালুচরের উদাস প্রশাস্তি পার হইয়া, দিগন্তের শুাম বনানীর গভীরতা অতিক্রম করিয়া, স্বদুর নক্ষত্রালোকে যেন কে অভিসারে চলিয়াছে । শুনিয়া শুনিয়াও আর তৃপ্তি হয় না । চোখের জলের ন্যায় করুণ, কিন্তু তেমনই সুন্দর। প্রত্যেকেরই মনে হয়, এত দিনের জীবনের নানা কৰ্ম্ম এবং ব্যস্ততার ভিতরে কি যেন সে চাহিয়া আসিয়াছে, এবং কি যেন পায় নাই । সকল আনন্দ-কোলাহলের ভিতরে তাহারই অজ্ঞাতে যে অকৃতাৰ্থ কামনার বেদন অব্যক্ত রহিয়াছিল, আজ এই নিভৃত নিশীথে বাণীর স্বর সেই বেদনারই প্রকাশের দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিল । পাহাড়ী মেয়েটির অশ্রু শুকাইয়া গিয়াছে। জানালার গরাদে মাথাটি রাখিয়া সে নদীর পানে চাহিয়া রহিয়াছে। বড় ভাল লাগিতেছে তাহার-বড় সুন্দর সুর। ভাইটির কথা পুনঃপুন মনে পড়িয়া ধাইতেছে, চিমনির আলোতে বসিয়া সে বাজাইতেছে। প্রবাসী বোনটির কথা কি মনে পড়ে না তাহার ? বঁাশী বাজাইতে বাজাষ্টতে প্রশংসাবাক্য শুনিবার আশায় ভুল করিয়া একবারও কি সে পিছন পানে চাহিয়া ফেলে না ? ফ্লোরিনের কবিতা স্মরণে আনিবার ব্যর্থ প্রয়াস থামিয়া গিয়াছে। না: ! পড়াশুনা ছাড়িয়া দিয়া বাণী শিখিলেই ভাল করিত সে। লজিকের সিলজিসমূ অপেক্ষ অনেক সহজ হইত নিশ্চয়ই। মাফলার বোন সমাপ্ত করিয়া শাস্ত উঠিয় দাড়াইয়াছে। দ্বারের পর্দাটা ভাল করিয়া সরাইয়া দিয়াছে, দূরে বংশী