পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৬৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হয়েছে পালামেন্টের রীতি মেনে, আমরাও সেই পথ অনুসরণ করব । ভুলে যাই যে, সে দেশে পালামেণ্ট বাইরে থেকে আমদানি করা জিনিষ নয়, অন্তকূল অবস্থায় ভিতর থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠা জিনিয। এককালে ইংলণ্ডে প্রটেষ্টাণ্ট এবং রোমান ক্যাথলিকদের মধ্যে প্রবল বিরোধ ছিল, কিন্তু বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও বিদ্যার প্রভাবে তা ক্ষীণ হয়ে দূর হয়েছে। ধৰ্ম্মের তফাৎ সেখানে মাতুষকে তফাৎ করে নি । মন্ত্যত্বের বিচ্ছিন্নতাই প্রধান সমস্যা। সেই জন্তই আমাদের মধ্যে কালে কালে যে-সব সাধক, চিন্তাশীল ব্যক্তিদের আবির্ভাব হয়েছে, তারা অনুভব করেছেন মিলনের পন্থাই ভারতপস্থা। মধ্যযুগে যখন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিচ্ছেদ বড় সমস্ত হয়ে উঠেছিল, তখন দাদু, কবীর প্রভৃতি সাধকগণ সেই বিচ্ছেদের মধ্যে আধ্যাত্মিক ঐক্য-সেতু প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ক'রে গেছেন। কিন্তু একটা কথা তারাও ভাবেন নি। প্রদেশে প্রদেশে আজ যে ভেদজ্ঞান, একই প্রদেশের মধ্যে যে পরস্পর ব্যবধান, একই সম্প্রদায়ের মধ্যেও যে বিভক্ততা, এ দুৰ্গতি তখন তাদের চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে নি। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার বিচ্ছেদ আমাদের পীড়া দিচ্ছে। এই পীড়া উভয় পক্ষেই নিরতিশয় দুঃসহ দুৰ্ব্বহ হয়ে উঠলে উভয়ের চেষ্টায় তার একটা নিষ্পত্তি হতে পারবে। কিন্তু এর চেয়ে দুঃসাধ্য সমস্ত হিন্দুদের, যারা শাশ্বত ধৰ্ম্মের দোহাই দিয়ে একই সম্প্রদায়ের মধ্যে মানুষের প্রতি স্ববুদ্ধিবিরুদ্ধ অসম্মানকর নিরর্থক ভাগবিভাগ নিত্য ক’রে রাখে । এই জন্যই মনে হয়, নিবিড় প্রদোষান্ধকারের মধ্যে আমাদের দেশে রামমোহন রায়ের জন্ম একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। পাশ্চাত্য শিক্ষার অনেক পূৰ্ব্বেই তার শিক্ষা ছিল প্রাচ্য বিদ্যায়। অথচ, ঘোরতর বিচ্ছেদের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান লাভ করবার মতো বড় মন তার ছিল । বর্তমান কালে অন্তত বাংলা দেশে ভারতীয় সংস্কৃতির সর্বপ্রথম দূত ছিলেন তিনি। বেদ, বেদান্তে, উপনিষদে র্তার পারদর্শিতা ছিল, আরবী পারসীতেও ছিল সমান অধিকার, শুধু ভাষাগত অধিকার নয়, ইদয়ের সহানুভূতিও ছিল সেই সঙ্গে । যে বুদ্ধি, যে জ্ঞান দেশকালের সঙ্কীর্ণতা ছাড়িয়ে যায় তারই আলোকে হিন্দু, মুসলমান এবং খ্ৰীষ্টিয়ান তার চিত্তে এসে মিলিত হয়েছিল। অসাধারণ দূরদৃষ্টির সঙ্গে সাৰ্ব্বভৌমিক নীতি এবং সংস্কৃতিকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। শুধু ধৰ্ম্ম এবং আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে নয়, কৰ্ম্মের ক্ষেত্রেও তার বুদ্ধি ছিল ধৰ্মগ। এদেশে রাষ্ট্রবুদ্ধির তিনিই প্রথম পরিচয় দিয়েছেন। আর নারীজাতির প্রতি তার বেদনাবোধের কথা কারও অবিদিত নেই। সতীদাহের মতো নিষ্ঠুর প্রথার নামে ধর্মের অবমাননা তার কাছে দুঃসহভাবে অশ্রদ্ধেয় হয়েছিল । সেদিন এই দুনীতিকে আঘাত করতে যে পৌরুষের প্রয়োজন ছিল আজ তা আমরা সুস্পষ্টভাবে ধারণা করতে পারি নে। রামমোহন রায়ের চিত্তভূমিতে বিভিন্ন সম্প্রদায় এসে মিলিত হতে পেরেছিল, এর প্রধান কারণ, ভারতীয় সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ উপদেশকে তিনি গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। ভারতীয় বিদ্যা এবং ধর্মের মধ্যে যেখানে সবাই মিলতে পারে, সেখানে ছিল তার সাধনার ক্ষেত্র, সেখান থেকেই তিনি বাণী সংগ্রহ করেছিলেন। সেই ছিল তার পাথেয় । ভারতের ঋষি যে আলো দেখেছিলেন অন্ধকারের পরপার হতে, সেই আলোই তিনি আপন জীবনযাত্রাপথের জন্য গ্রহণ করেছিলেন । ভাবলেও বিস্ময় জন্মে যে, সেই সময়ে কী ক’রে আমাদের দেশে তার অভ্যাগম সম্ভবপর হয়েছে । তখন দেশে একটা দল ইংরেজি শিক্ষার অত্যন্ত বিরুদ্ধে ছিলেন, ম্লেচ্ছবিস্তাতে অভিভূত হয়ে আমরা ধৰ্ম্মচ্যুত হয়ে পড়ব, এই ছিল তাদের ভয়। এ কথা কেউ বলতে পারবে না যে, রামমোহন পাশ্চাত্য বিদ্যা দ্বারা বিহবল হয়ে পড়েছিলেন, প্রাচীন সংস্কৃত শাস্ত্রজ্ঞান তার গভীর ছিল, অথচ, তিনি সাহস করে বলতে পেরেছিলেন-দেশে বিজ্ঞানমূলক পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার চাই। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিদ্যার যথার্থ সমন্বয় সাধন করতে তিনি চেয়েছিলেন। বুদ্ধি জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক সম্পদের ক্ষেত্রে তার এই ঐক্যসাধনের বাণী ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক আশ্চৰ্য্য ঘটনা । আজ যদি তাকে আমরা ভাল ক'রে স্বীকার করতে না পারি, সে আমাদেরই দুৰ্ব্বলতা। জীবিতকালে তার প্রত্যেক কাজে আমরা তাকে পদে পদে ঠেকিয়েছি। আজও যদি আমরা তাকে খৰ্ব্ব করবার জন্ত উষ্ঠত হয়ে