কাৰ্ত্তিক -_ মহামায়া সংসারের কাজে ক্রমশঃই অপটু হইয়৷ পড়িতেছেন বলিয়া ছেলেমেয়ের পড়াশুনার ভারটাই বেশী করিয়া নিজে টানিয়া লইতেছিলেন। স্বধা যতক্ষণ ছোট পোকার দৌরাত্ম্য লইয়া ব্যস্ত থাকে, মহামায়া ততক্ষণ শিবুর মানসিক উন্নতির চেষ্টায় মন দেন। পাওয়াদাওয়ার পর খোকন শ্রাস্ত হইয়া ঘুমাইয় পড়িলে সুধা তাহার বালি কাগজের খাতা, আখ্যানমঞ্জরী, উপক্রমণিকা, স্থতাতোলা রুমাল ও মিহি চুলের দড়ি ইত্যাদি লইয়া মায়ের কাছে আসে। হয়ত আজ এতক্ষণে শিবুর পড়া হইয়া গিয়াছে মনে করিয়া সুধা আসিয়া দেখিল, মেঝের উপর ‘বোধোদয়’ ও ‘নব ধারাপাত গড়াগড়ি যাইতেছে, শিবু শ্লেটপানা বুকের উপর চাপিয়া চিৎ হইয়া মা’র কোলে মাথা রাগিয়া ই করিয়৷ র্তাহার হাস্তোজ্জল অনিন্দ্যসুন্দর মুখের দিকে তাকাইয় আছে। মা শিবুকে গল্প বলিতেছেন। বুড়ে ছেলের এখনও মা’র কোলে গুইয়া গল্প শোনার সখ মিটে নাই । স্বধী ছোটখোকাকে মেঝেতে ছাড়িয়া দিয়া দূর হইতে শুনিতে লাগিল, গল্প ত নয়, মা কি সব ছড়া বলিতেছেন : — “হাড় হ’ল ভাজ ভাজা মাস হ’ল দড়ি আয়রে ভাই সাগরজলে ঝাপ দিয়ে পড়ি ।” “ভাত কড় কড় ব্যয়ন বাসি দুধ বিড়ালে খায়, তোমার খেলাবার সার্থী উপবাসী যায়।” মা কেন আজ এই সব ছড়া বলিতেছেন ? স্বধী মনে করিয়াছিল মা হয়ত শিবুকে সাত বউয়ের গল্পের “সাত বৌএর সাত আসকে, খড়কের আগায় ঘি খুত খুত খুঁত করছ কেন খেতে লারছ কি ?” ছড়া শুনাইতেছেন। তাহত নয়, মা’রও মন চঞ্চল হইয়াছে, তাই এই সব বিচ্ছেদব্যথার করুণ সুর তাহারও মনে ঝঙ্কার দিয়া উঠিয়াছে। হৈমবতী কুধার খেলার সার্থী নন, ভৰু স্বধার মনে হইল তাহারা যখন তাহাকে এই শূন্তগুহে ফেলিয়া দিয়া দূরে চলিয়া যাইবে, তখন আনমন পিসিমার ভাত ব্যঞ্জন এমনই অবহেলায় পড়িয়া নষ্ট হইবে, তিনি উপবাসী বসিয়া মানসচক্ষে স্বধা শিবু খোকার প্রিয় মুখগুলি মুরাইয়া ঘুরাইয়া দেখিবেন। সদ্যমাতৃবক্ষচ্যুত শিশুবধুর মত র্তাহারও প্রিয়জনবিরহে সাগরজলে বfiপাইয়া পড়িতে ইচ্ছা করিবে । অলখ-বেণরণ
- S
এই করুণ স্বর স্বধার আর ভাল লাগিল না। সে বলিল, “মা, খোকনের ঘুম এসেছে, ওকে তুমি একটু দেখো। শিবু, চল মুখুয্যেবাধের ধারে অনেক চকুমকি পাথর দেখে এসেছি, কুড়িয়ে আনি গে।” to শিবু তড়াকৃ করিয়া মা’র কোল হইতে লাফাইয়া উঠিয়া বই দুইটা ঘরের ছাদ পয্যন্ত ছুড়িয়া দিয়া আবার লুফিয়৷ লষ্টল। তাহার পর সাওতালদের স্বরে— “বাবুদের কলাবাগানে, ওলে, আমার গোলাপকাটা ফটেছিল চরণে।” গাহিতে গাহিতে সুধাকে টানিয়া ঘরের বাহিরে লইয়া গেল। বাহিরে আসিয়া শিবু সানন্দে স্বধার চুলের মুঠি ধরিয়া টানিয়া বলিল, “দিদি, জান আমরা কলকাতা যাব ? দু-জনেই ইস্কুলে ভৰ্ত্তি হব।" স্বধ গম্ভীর বিষণ্ণ মুখ করিয়া বলিল, “তোর ভাল লাগছে ?” শিবু দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল, “ভাল ? আমার ইচ্ছে করছে এথ খুনি হন্তমানের লঙ্ক যাত্রার মত এক লাফে কলকাতায় গিয়ে পড়ি ।” স্বধা বলিল, “ভাগ্যে ভগবান তোকে লেজটা দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। না হ’লে তুই সাক্ষাৎ হকুমানের মত গাছের ডাল থেকে আর নামতিস না। কলকাত যাবার জন্যে যে এত ক্ষেপেছিল, সেখানে কি এমনি আমগাছ আর পেয়ারা গাছের ডালে বসে থাকতে পাবি ? পিলিমা বলেছেন সে ভারী শহর, সেখানে শুধু রাস্ত বাজার আর বাড়ী, গাছপাল৷ কিছু নেই।” শিবু বলিল, “আগাগোড়াই নূতন রকম দেশ, তাহলে ত আরোই মজা ।” কিন্তু সম্পূর্ণ নূতনের কল্পনায় স্থধার মন ভরিল না। ভোরবেল বিছান হইতে উঠিয়া তাহার চিরপরিচিত শিরীষ ফুলের গাছের পিছনে আকাশ রাঙা করিয়া স্বর্ণ কলসের মত স্বর্ধ্যের উদয় যদি না দেখিতে পাওয়া যায়, যদি মেঘে মেঘে সাত রঙের ফাগ ছড়াইয়া সন্ধ্যার স্বৰ্য্য ঐ স্থ্যজপৃষ্ঠ শৈলমালার পিছনে না অস্তহিত হয়, তবে কিসের সে কলিকাতা ? শুক্ল পক্ষের মাঝ রাত্রে অন্ধকার ঘরে যখন ঘুম ভাঙিয়া যাইবে তখন পুকুর পাড়ের ঝাঁকড়া কালো