পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৯২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

স্নিগ্ধ নিশ্চিন্ত গ্রাম্য কুটীরের উত্তেজনাবিহীন মাতৃক্রোড়ে স্থান লাভ করতে পারে ; যেখানে একটিমাত্র বিষ্ণু' হিংসাতপ্ত জর্জরিত জীবনকে সে আপনার স্নেহের আশ্রয়ে স্নিগ্ধ শাস্ত পরিতৃপ্ত ক’রে সে নিজের অবখ্যাত অস্তিত্বের শাস্তিপূর্ণ অবসানের মধ্যে অনন্ত বিস্মৃতিসাগরের একটি বুদ্ধদের মত মিশিয়ে যেতে পারবে । সারেঙ গল্প করে চলেছিল মনের আনন্দে, তার মধ্যে অধিকাংশই তার আত্মকথা ; তার জলচর-জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার বিস্ময়কর ইতিহাস । সত্যের চেয়ে রূপকথার সঙ্গেই তার সম্পর্ক অধিক । কিন্তু বহু আবৃত্তির ফলে তারও মনে সেগুলি বিশ্বাসের কেন্দ্রে স্থান পেয়েছে । সত্য মিথ্যায় পূর্ণ তার এই সরল কাহিনী নিখিলের মনে আনন্দের সঞ্চার কম করে নি। মাঝে মাঝে প্রশংসাপূর্ণ প্রশ্ন ক’রে গল্পের ধারাকে সে অক্ষুণ্ণ রাখলে । আত্মকাহিনীর গতিবেগ স্তিমিত হয়ে এলে এক সময় নিখিল তাকে প্রশ্ন করলে, “হ্যা, সাহেব, এই কমলাপুরীতে নাকি কোন পুরুষমানুষ নেই—সব নাকি মেয়ের করে ? সত্যি ? কোন পুরুষ সেখানে যেতে পায় না ?” সারেঙ প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললে, “উহু একেবারে বাদশাহদের হারেমের মত ” তুলনাটা ঠিক নয়, তবু সারেঙের মনে কমলাপুরী সম্বন্ধে গৰ্ব্ব করবার ওর চেয়ে আর সম্মানজনক উপমা তার মনে ছিল না। তার পর একটু থেমে বললে, “কেবল রাজাসাহেব মাসে একবার আসেন। তা সাহেব সেই ত বাদশাহ ” কথাটা বিসদৃশ, কিন্তু সে বেচারার মনে মনিবের পদমৰ্য্যাদার পরিমাণটা বোঝাবার আগ্রহও কম নয় । তার কথায় হাসি পেলেও নিখিল গম্ভীর হয়েই শুনছিল । কৌতুহলও হ’ল তার, বললে, “পাৰ্ব্বতী দেবী মালিক না ?” সারেঙ আবার উৎসাহের সহিত বললে, “আলবৎ, ওই ত সব। রাজাসাহেব ত শুধু টাকা দিয়ে খালাস। তিনি জমিদার কিনা ! পেল্পায় জমিদার সাহেব । গ্রামে তার হাতীঘোড়া, লোকলস্কর, সাত মহলা বাড়ী—বাড়ী ত নয় একটা শহর ।” “বটে । তা নিজের গ্রামে এ সব না করে এমন একটা জায়গায় এ-সব কেন করলেন ?” “তা কি জানি সাহেব। রাজা-রাজড়ার মজি । গ্রাণে ত তিনি থাকেনই না। বেলাত থেকে আসার পর কলকাতাতেই বেশী থাকেন। সাহেব-লোকের কি গ্রামে ভাল লাগে আর । আর তা লাগবেই বা কি সাহেব, রাণীমা ছিল যেন ‘বেহস্তর পরী”। আমন জরু গেলে - লোকে গলায় দড়ি দেয় ।” এবার নিখিল একটু হেসেই ফেললে। তারপর জিজ্ঞেস করলে, “প্লাজার ছেলেপিলে নেই বুঝি ?” “হায় আল্লা, ছেলেও ত ঐ এক সাথে গেছে। কত তল্লাস হ’ল সাহেব ; তা কারোরই খোজ মিলল না।” ব’লে সারেঙ অত্যস্ত ব্যথিত হয়েই বোধ করি বাইরের দিকে চেয়ে চুপ করলে । নিখিলনাথ এতক্ষণ অলস অবসর ষাপন করবার আশায় শিথিল চিত্তে গল্প শুনছিল । হঠাৎ সে খাড়া হ’য়ে বসে সারেডের হাত প্রায় চেপে ধরলে । এত বড় আশ্চৰ্য্য সংবাদ যে এই দুঃসময়ে তার কাছে এসে ধরা দেবে, তা যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না । কিছুক্ষণের জন্তে সে কালকের দুর্ঘটনা, সীমার সর্বনাশ, ভবিষ্যতের দুর্ভাবনা সব ভুলে গেল । সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলে, “বল, বল সাহেব, বল ত ব্যাপারটা কি ? তোমাদের রাণীমা আর তার ছেলে কি হারিয়ে গেছে ?” তার এই আগ্রহ এবং কৌতুহলে সারেঙ অভ্যস্ত আশ্চৰ্য্য হ’ল । বিরক্তও হ’ল মনে মনে । এতখানি গল্প করার তার ইচ্ছে ছিল না । কিন্তু লিখিলনাথের স্বাভাবিক সৌজন্ম এবং সহানুভূতির ছোয়া পেয়ে সেদিন গল্প করতে করতে তারও মনটা একটু অসাবধান হয়ে পড়েছিল। এখন সচেতন হয়ে সে মনে মনে চটে গেল । তার মনে হ’ল ঘরের বৌয়ের নিরুদ্দেশের সংবাদে কেমন যেন ইজ্জতের হানি হ’য়ে যাচ্ছে—প্রায় একটা বে-আবরু হওয়ার সামিল যেন । হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সে বললে, “আতশত জানি নে । হারিয়ে গেছে না চোরে নেছে, তাতে আপনার আমার কি ? আমার অনেক কাজ সাহেব, তুমি আপনার কামরায় যাও।” ব’লে হঠাৎ পিছন ফিরে সে চলে গেল । নিখিল ব্যাপারটা বুঝলে। ঘরের গৃহিণী নিরুদেশ হওয়া যে আমাদের দেশে কত বড় দুনামের ব্যাপার ত