পাতা:প্রবাসী (ষট্‌ত্রিংশ ভাগ, দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৯৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মরলে বরং সওয়া যায়। কোথায় যেন মিলিয়ে গেল বাবু। কত খুঁজলাম, তা আর পাওয়া গেল না। সেই থেকে বৌমার শোকে বাবু কতদিন একেবারে পাগলপারা হয়ে রইল । তার পর বেলাত চলে গেল। ফিরে এসে বৌমার নামে ঐ কমলাপুরী করলে। সে আজ পাচ-ছয় বছর হতে চলল। এদিন কি আর আছে বাৰু ? তা বাবুর মতিগতি খারাপ নয়। আর বে-থা করলে না। সেই মাঝে মাঝে প্রাগে গিয়ে থাকে। ঐ খেনেই কুম্ভমেলায় বৌমা হেরিয়ে মান কি না । এবারে কোথায় যে গেল আমারে সঙ্গে নিলে না। কত বললুম তা শুনলে না। গেছে ঐ প্রাগেই ঠিক ” বলে সে অন্যমনস্ক ভাবে চিন্তামগ্ন হয়ে চলতে লাগল । নিখিল আর কোন প্রশ্ন করলে না। আর কোন প্রশ্নের আবিস্তকও ছিল না তার । তার মনে আর সংশয় বড় ছিল না । ডিট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তায় তুলে দিয়ে ভোলানাথ ফিরে গেল। চিস্তায় নিমগ্ন নিখিল পথশ্রমের কষ্ট সম্পূর্ণ বিস্তুত হয়ে চলতে লাগল। তার মনে নূতন আশঙ্কা ঘনিয়ে উঠেছে। সীমা যে সম্প্রতি শচীন্দ্রনাথের অনুসন্ধানেই তার গ্রামে গিয়েছে এ-বিষয়ে তার আর কোন সন্দেহমাত্র রইল না। এতে শচীন্দ্রের বিপদ কল্পনা করে নিখিলের মন অত্যন্ত বিচলিত হ’ল । রঙ্গলালের কবলে পড়লে শচীন্দ্রনাথের যে কি পরিণাম হবে সম্প্রতি নন্দলালের হত্যার পর তা কল্পনা করতেও তার মন কণ্টকিত হয়ে উঠছিল। শচীন্দ্রনাথ যদি সত্যই জ্যোৎস্নার স্বামী হয় এবং তার সমূহ বিপদ জেনেও যদি নিজের মোহের দুৰ্ব্বলতায় তাকে সেই বিপদে রক্ষা করবার চেষ্টা সে না করে, তবে সে অসহায় জ্যোৎস্নার শুভানুধ্যায়ী সেজে তারই সৰ্ব্বনাশের পথ পরিষ্কার করা সম্বন্ধে নন্দলালের চেয়ে কোন অংশে শ্রেষ্ঠ ? চিন্তার বেগে তার চলার গতিও বেড়ে চলল। উত্তেজনার আবেগে সে মনে মনে প্রতিজ্ঞ করলে যে, যেমন করেই হোক সীমাকে সে নিবৃত্ত করবে—শচীন্দ্রের সর্বনাশ সে ঘটতে দেবে না । সন্ধ্যা সমাগতপ্রায় । বিস্তৃত প্রাস্তরের প্রাস্তসীমায়ু স্বৰ্য্যান্তের বর্ণচ্ছটায় দিকচক্র অসুরঞ্জিত। গুীমায়মান ব্যাপ্ত আকাশের তলে জনমানব-পরিশূন্ত বিরাট প্রাস্তরের মধ্যে দিশাহারা দীর্ঘপথ আশা আনন্দ আশ্রয় বিহীন - মধ্যাহ্নের প্রচণ্ড স্থৰ্য্যতাপ আপনার অগ্নিদাহে যেন মূৰ্ছাতুর । ক্লান্ত চরণ চলতে আর চায় না। তবু তার বিশ্রাম করবার অবসর নেই। পথ এখনও মাইল চারেক বাকী । ষ্টেশনে যখন সে পৌছল ট্রেন আসতে তখন আর বড় বিলম্ব নেই, বড় জোর আধ ঘণ্টা । ছোট ষ্টেশনটিতে তখনও ভৈলাপচয়ের ভয়ে আলোগুলিকে সজীব ক’রে তোলা হয় নি। নিখিল সেই অন্ধকারপ্রায় প্লাটফমে দাড়িয়ে একটু চিস্ত করে নিলে। তার মনে ভয় ছিল ষে সীমা সিংহযোড়ে না নেমে হয়ত সোজা কলকাতায় চলে গিয়েছে । খবরটা পাওয়া দরকার মনে ক’রে সে সোজা ষ্টেশন ঘরে ঢুকে সিংহযোড়ের একটা প্রথম শ্রেণীর টিকিট চাইল । ফল ফলতে দেরী হ’ল না। একে প্রথম শ্রেণী, তায় সাহেবী পোষাক, গ্রাম-অঞ্চলে এ মণিকাঞ্চন বড় মেলে না । ষ্টেশনমাষ্টার ভারি খাতির করে নিখিলকে বসালে । সন্ধ্যাবেলায় যে দু-এক জন বৃদ্ধের পাশা খেলতে সেখানে সমাগম হয় তারাও নিখিলের উপর সসম্রম দৃষ্টি রেখে নড়ে-চড়ে ভব্য হয়ে বসল। নিখিল সবিনয়ে তাদের নত হয়ে নমস্কার জানিয়ে একটু-আধটু খোজখবর নিতে লাগল। সাহেবের সমতুল্য একজন প্রথম শ্রেণীর যাত্রীকে এমন বিনীত ঘরোয়া রকমের আলাপপরায়ণ দেখে মহা খুশী হয়ে বৃদ্ধদ্বয় গল্প জুড়ে দিলে । নিখিলনাথ শচীন্দ্রের পরিচিত নয় জেনে তাদের রসন৷ চটুল হয়ে উঠল। বললে, “হ্যা, জমিদার ছিল বটে শচীন সিংহীর বাপ । তার দাপটে বাধে গরুতে এক ঘাটে জল থেত। আর এ একটা মনুষ্য নয়। একটা বেী হারিয়ে যে পাগল হয়, সে আবার কি একটা মানুষ । বেী গেছে গেছে, তার কি হয়েছে ? এতবড় জমিদারী, আবার বে-থা কর, পায়ের উপর পা দিয়ে বসে খা । তা নয়, বিলেত গিয়ে খ্ৰীষ্টান হয়েছে। আবার শুনতে পাই, বিলেত থেকে একটা খ্ৰীষ্টান মাগী এনেছে, তাকে দিয়ে বিধবাদের সব খ্ৰীষ্টান করাবার মতলব । শুনছি তাকে নাকি বে করবে। ধন্ম আর রাখলে না।”